নিজেরা পরবাসী হতেই কি তাদের আদিবাসী বলব by মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর-প্রতীক

গত তিন দিন একাধিকবার টেলিভিশনে টকশোতে যাওয়ার জন্য দাওয়াত এসেছিল, একটি দৈনিক পত্রিকা কর্তৃক আয়োজিত আলোচনায়ও থাকতে হয়েছিল। যে বিষয়গুলো উপস্থাপনের সুযোগ হয়েছে, অথবা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলতে হয়, উপস্থাপন করার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল সেগুলো নিম্নরূপ-
প্রথমত, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে যারা নৃ-তাত্ত্বিক সংখ্যালঘু তাদের একটি দাবি নিয়ে যখন তারা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চায়- এর তাৎপর্য কী। দ্বিতীয়ত, ১৮ দলীয় জোটের এই মুহূর্তের প্রধান রাজনৈতিক দাবি যথা আগামী সংসদ নির্বাচনকালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন্দোবস্ত।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৫ কোটি থেকে ১৬ কোটির মাঝখানে। জাতিগতভাবে তথা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তায় এবং নৃ-তাতাত্ত্বিক বিচারে ৯৮ শতাংশই হচ্ছে বাঙালি এবং মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের অ্যাংলো এশিয়ান বলা হয় তাদের অংশ। বাকি দুই শতাংশ হচ্ছে অনেক ভাষার অধিকারী, একাধিক বর্ণ ও ধর্মের অধিকারী এবং নৃ-তাতাত্ত্বিকভাবে মানবগোষ্ঠীর যাদের মঙ্গোলীয় বলা হয় তাদের অংশ। এই দ্বিতীয় অংশকে আমরা এত দিন উপজাতি বলে এসেছি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত তিনটি পার্বত্য জেলার সম্মিলিত নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখানে বসবাস করে ১২টি কিংবা মতভেদে ১৩টি উপজাতি। এর বাইরে অন্তত আরো ৩৩টি ছোট ছোট উপজাতি বাস করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, বাংলাদেশের উত্তর অংশে তথা উত্তরবঙ্গে এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ-সিলেট অঞ্চলে।
১৯৭২-এর সংবিধানে তাদের বাঙালি বলা হয়েছে। ব্রিটিশ আমল বা পাকিস্তান আমলে তাদের ওপর অন্যায় হয়েছে। বিশেষ করে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি, তারা নিজেদের গুরুতরভাবে বঞ্চিত এবং নির্যাতিত মনে করে। এর ফলে ডিসেম্বর ১৯৭৫-এ পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহী উপজাতীয় সংগঠন যার নাম শান্তিবাহিনী, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো এই যে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশই জানে না, কী কারণে সেই সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং সেই সংঘাত নিরসনে কী কী আর্থ-সামাজিক পদক্ষেপ কোন কোন আমলে নেওয়া হয়েছে। অধিকতর দুঃখজনক আরেকটি বিষয় হলো, এই যে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশ বলে বেড়ায় এবং বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে পাহাড়ে বাঙালিদের বসতি করতে দেওয়ায় সমস্যা শুরু হয়েছে। সুযোগ এবং পরিবেশের অভাবে ওই বিষয়গুলো নিয়ে গভীর আলোচনা কম হয়। ফলে ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর হয় না। আজকের সংক্ষিপ্ত কলামে এ বিষয়ে বলব না, সম্পাদক মহোদয়ের অনুমতিক্রমে ধারাবাহিক পাঁচটি কলাম লিখব। আগামী সেপ্টেম্বর অক্টোবরে। সম্মানিত পাঠককুলের খেদমতে।
আজকে যার ওপর গুরুত্ব দেব সেটা হলো, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে সম্বোধন করা বা অভিহিত করা এবং এর তাৎপর্য। পাঁচ-সাত বছর ধরে মিডিয়ায় একটু একটু করে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার বেড়েছে। এতে বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। উদ্বেগ আর মহাচিন্তা শুরু হলো তখনই, যখন উপজাতীয় নেতৃত্বের এক অংশ জোরালো তৎপরতা শুরু করল এই বলে যে উপজাতীয়দের সাংবিধানিকভাবে 'আদিবাসী' পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে। অর্থাৎ সামাজিক পরিচয় থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিচয় নেওয়া। বর্তমানে শাসক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে ফেলেছে ৪৬ মাস আগে। আন্দোলনকারীদের জন্য এটা একটা অনুকূলীয় পয়েন্ট; কিন্তু আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ তাৎপর্য না বুঝেই শব্দটি ব্যবহার করেছিল। প্রধানমন্ত্রী এক বা দুই বছর আগে ৯ আগস্ট দিবসটি পালন উপলক্ষে যেই বাণী দিয়েছিলেন সেখানেও তিনি আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যথাসম্ভব তাঁর সহায়তাকারীদের বোঝার অভাবের কারণে। প্রায় ১২ মাস ধরে বর্তমান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী শব্দের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে আন্দোলনকারী উপজাতীয় নেতারা সাংঘাতিকভাবে নাখোশ ও বিরক্ত। তাহলে আমাদের জানা অবশ্যই প্রয়োজন কী কারণে শব্দটির ব্যবহারে নিরুৎসাহী করা হচ্ছে, যা সরকার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না বলেছে।
জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বহু বছর আগে, নাম ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন, যাকে সংক্ষেপে আইএলও বলা হয়। আইএলও অনেক বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ১৯৫৭ সালে আইএলও একটি কনভেনশন 'অ্যাডাপ্ট' করে। বিষয় ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নৃ-তাতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। এখানে বলতেই হবে যে কারা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা কারা সংখ্যালঘু এটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কারণ রাজনৈতিক সীমারেখার কারণে একজন আরেকজনকে সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু বলতেই পারে।
আইএলওর কনভেনশনটি অনেক কিছু নিয়ে বিস্তৃত ও নিবিড়ভাবে লিখেনি। পৃথিবীর অনেক দেশ এটিকে অনুস্বাক্ষর বা রেটিফাই করেছিল আবার অনেকে করেনি। স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-এ বাংলাদেশ এটিকে রেটিফাই করে। ইতিমধ্যে ১৯৭৫-এর ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনী, ১৯৫৭ সালের কনভেনশনটিকে পরিবর্ধন, পরিমার্জন এবং পরিশীলন করা, একই আইএলও ১৯৮৯ সালে আরেকটি কনভেনশন 'অ্যাডাপ্ট' করে। যার নম্বর হচ্ছে ১৬৯।
পৃথিবীর বহু দেশ ১৬৯ কনভেনশনটিকে অনুস্বাক্ষর করে আবার বহু দেশ করে না। বিশ্বের দেশে দেশে নৃ-তাতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতারা তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁদের উদ্যোগে জাতিসংঘের মধ্যে অন্য সংস্থাগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু নৃ-তাতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের প্রসঙ্গে জাতিসংঘ একটি ফোরামও গঠন করে। তাদের সবার সম্মিলিত উদ্যোগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি ঘোষণা 'অ্যাডাপ্ট' করে। বেশির ভাগ দেশ পক্ষে ভোট দেয়, অল্প কিছু দেশ বিরুদ্ধে ভোট দেয় এবং কয়েকটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত ছিল। এই প্রেক্ষাপটেই চার-পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-তাতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিছু নেতা, নিজেদের আদিবাসী হিসেবে সরকারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সচেষ্ট হন।
মুখে মুখে কাউকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করা আপাতত কোনো বড় ঝামেলার বিষয় নয়; কিন্তু দীর্ঘকাল অভ্যাসের কারণে এটি অধিকারে পরিণত হয়। এটিই ভয়ের কারণ। অন্যদিকে পার্লামেন্টে আইনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া বিপজ্জনক বলে মনে করি। কারণ অতি সংক্ষেপে বলছি। জাতিসংঘের সাধারণ সভার ২০০৭ সালের ঘোষণা মোতাবেক যারা আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী, তাদের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অধিকার থাকবে এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা কিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা পাবে। প্রথম উদাহরণ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আইনগতভাবেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায়, রাইট অব শেলফ ডিটারমিনেশন। যেই অধিকার কাশ্মীরকে ভারত দিচ্ছে না ৬৪ বছর ধরে, উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকদের ভারত দিচ্ছে না ৫৮ বছর ধরে, দক্ষিণ ফিলিপাইনে অবস্থিত মিন্দানাও এলাকার মুসলমানদের দিচ্ছে না ফিলিপাইনের খ্রিস্টান সরকার, যে অধিকার ইন্দোনেশিয়া সরকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল পূর্ব তিমুরের খ্রিস্টান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে; ১৯৯৮ সাল থেকে নিয়ে পেছনের দিকে ২০ বছর ধরে। বাংলাদেশ কি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সুযোগ দেবে, 'যথা আপনারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণ সর্বজনীন ভোটের মাধ্যমে তথা রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিন এই মর্মে যে আপনারা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত থাকবেন কি থাকবেন না?' এই প্রশ্ন এবং এই উত্তরের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার দায়িত্ব সম্মানিত পাঠককুলের। দ্বিতীয় উদাহরণ : আনুষ্ঠানিক আদিবাসীদের ভূমির ওপর সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ যথা বনজঙ্গল এবং ভূমির নিচের প্রাকৃতিক সম্পদ যথা গ্যাস তেল, কয়লা ইত্যাদির একমাত্র এবং একচ্ছত্র মালিক হলো আনুষ্ঠানিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ২০০৭ সালের জাতিসংঘ ঘোষণা মোতাবেক বাংলাদেশ সরকার যদি আমাদের নৃ-তাতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়, তাহলে ওই স্বীকৃতির বদৌলতেই আদিবাসীরা যে সুযোগ-সুবিধা পাবে, সেটা যদি বাংলাদেশ সরকার দিতে অপারগ হয় অথবা গড়িমসি করে তাহলে আদিবাসীরা এর প্রতিকারস্বরূপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে কারিগরি ও আর্থিক সাহায্য সরাসরি চাইতে পারবে। বিবেচ্য বিষয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কোনো ক্রমেই অটুট থাকবে?
বিষয়টি এত স্পর্শকাতর ও গভীর বিশ্লেষণের দাবিদার যে এই ক্ষুদ্র কলামের মাধ্যমে সুবিচার করা সম্ভব নয়। আগ্রহী পাঠককুল নিজে কষ্ট করে ইন্টারনেট থেকেও কিছু জানতে পারবেন।

লেখক : চেয়ারম্যান বাংলাদেশ কল্যাণপার্টি এবং নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.