প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত by শাহজাহান মিয়া

গত ৩০ জুলাই লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় বিরোধী দলকে নিয়ে সরকার গঠনের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের সময় সরকার গঠনে বিরোধী দল যদি ‘অংশীদারিত্ব’ চায় সেটা দেয়া যেতে পারে। সবাই মিলেই আমরা নির্বাচন করতে পারি। একটা ছোট মন্ত্রিসভা করে নির্বাচন হতে পারে।


প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে। সেই তিন মাস সংসদের কোন অধিবেশন থাকবে না এবং সংসদ সদস্যদের কোন কার্যকর ক্ষমতাও থাকবে না। ফলে সংসদ সদস্যরা কোনরূপ প্রভাব খাটাতেও পারবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়ে বিকল্প হিসেবে শেখ হাসিনা নির্বাচন পরিচালনায় সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। ৩০তম অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে এক সরকারী সফরে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের হার্ডটক ও বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাতকারে এ সব কথা বলেছেন। গত বছরের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর তা পুনর্বহালের বিএনপির দাবি সঙ্গত কারণেই সরকার প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপিসহ বিরোধী দলের যুক্তি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। অন্যদিকে, বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সরকারী দল বলছে, অনির্বাচিতদের হাতে আর ক্ষমতা তুলে দেয়া ঠিক হবে না।
তবে বিরাধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। বেগম জিয়া বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া কোন নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না এবং এ ধরনের কোন নির্বাচন তারা হতেও দেবে না। বরং তারা আসন্ন ঈদের পর ১৮ দলীয় জোটকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার দাবিতে আন্দোলন তীব্র করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। বিরোধীদলীয় নেতার এ বক্তব্য আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে তা আরও ঘনীভূত হবে হলে দেশবাসী আশঙ্কা করছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী হুট করে তাঁর মতামত প্রকাশ না করে কিছুটা সময় নিয়ে একটা সুচিন্তিত মতামত দিতে পারতেন। অবশ্য সরকারী ও বিরোধী দল উভয় পক্ষই বেমালুম ভুলে যায় যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমঝোতা না হলে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া অবস্থারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা দেশের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচন নয়, বর্তমান সরকারের এমন কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসায় মানুষ তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছে। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর সেদিকে যে ফেরার তেমন উপায় নেই তা বিরোধী দলের কাছেও অজানা নয়। জনগণ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি যে সম্ভবত এ বছরের প্রথম দিকে বেগম জিয়া নিজেই বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও তারা মেনে নেবে। এখন যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই পক্ষের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন, বিরোধী দল সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আসলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের নামে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আড়ালে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করলেও দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সঙ্কট নিরসনে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও আগামী নির্বাচনে সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবে সাড়া দিতে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছেন। ব্যারিস্টার হক বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমার মনে হয়েছে সমঝোতা হবেই। এখন বিরোধী দলের ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসা উচিত।” ব্যারিস্টার রফিক আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এভাবে প্রত্যাখ্যান না করে বিএনপি বলতে পারত ওই সরকারে কারা থাকবে বা কোন দলের কয়জন থাকবে। সেই সরকারের প্রধানই বা কে হবেন।” নির্দলীয় একজন ব্যক্তিকেই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। উভয় পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি সুরাহা করে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান মোটেই অসম্ভব নয়। আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণে এবং সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য দেশী-বিদেশী চাপও অব্যাহত রয়েছে। বিদেশীদের বক্তব্য হচ্ছে, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও এ ধারণাই পোষণ করে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু, সুন্দর ও সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেবে এটাই দেশবাসীর কামনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে বিরোধী দল আলোচনায় বসলে তাদের উদ্দেশ্য যে ভাল এটা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত। সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলকে আলোচনায় বসার জন্য বার বার বলা হচ্ছে এবং তাঁদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করার জন্যও অনুরোধ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব পেশ করার পর সরকারী দলের তরফ থেকে একাধিক সিনিয়র নেতা বিএনপিকে তাদের প্রস্তাব পেশ করার কথা বলেছেন। বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা তা মোটেই আমলে নিচ্ছেন না। তাঁদের মধ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা গেলে তা তাদের রাজনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। এ লড়াইয়ে তারা বিজয়ী হলে নির্বাচনেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিরোধী দলের মতিগতি দেখে তাঁরা যে ঈদের পর সংলাপে বসবে সে বিষয়েও নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। আর বসলেও সংলাপে ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন যে নিরাশায় পর্যবসিত হবে না সে আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের নামে যে প্রহসন হয়েছে তা জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের দু’টি প্রধান দলের সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায়ই পর্যবসিত হয়েছিল। এবারও যদি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় তা কতটা সফল হবে তা বলা খুবই মুশকিল। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মোতাবেক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন সেটা স্পষ্ট হয়নি। বিরোধী দল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব মেনে নিলেও তার প্রধান হিসেবে একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তির প্রশ্নে ছাড় দিতে তারা চাইবে না। সমস্যা সমাধানে সব পক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে। এক-এগারোর দুঃসহ স্মৃতি এখনও কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। রাজনীতিকদের তো নয়ই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এদেশে বেশ আলোড়নই সৃষ্টি করেছিল। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কিছু অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ থাকলেও প্রথম দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি সচেষ্ট ছিল। বিদেশীদের কাছে আমাদের অনেক কিছুই গ্রহণযোগ্য না হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার তারা প্রশংসা করেছেন। কারণ কোন দেশ এটাকে মডেল হিসাবে গ্রহণ করার চিন্তা-ভাবনাও শুরু“করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশই এই ব্যবস্থায় প্রথম চরম বিপত্তি বেধে গিয়েছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ছাত্র-শিক্ষকসহ দেশের অনেক সাধারণ মানুষেরও ভোগান্তির শেষ ছিল না। জনগণের তা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তিন মাসের সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সীমাহীন তা-বের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর দেশের মানুষের প্রচ- ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মজার কথা হচ্ছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সম্প্রতি তিনি আরও বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এম হাসানকে নিয়ে প্রচ- সমালোচনার ঝড় উঠার পর পরবর্তী প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিনকে প্রধান উপদেষ্টা করলেও ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি এড়ানো যেত বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে ড. ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরী অবস্থা জারি করে সরকার প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। পর দিন ১২ জানুয়ারি ড. ফখরুদ্দীন আহমদ প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। দেরিতে হলেও এ রকম মারাত্মক ভুলের কথা স্বীকার করায় বেগম জিয়া ধন্যবাদ পেতেই পারেন। ২০০০ সালের প্রথম দিকে বিচারপতি লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার ওয়াশিংটনে দেখা হয়েছিল। গত ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিভিন্ন পত্রিকায় আমি গোটা দশেক নিবন্ধ লিখেছিলাম। ওই বছর ১৯ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত আমার একটি লেখায় আমি তাঁর কিছুটা প্রশংসাও করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা এতটা ভুল প্রমাণিত হবে সেজন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাঁর সঙ্গে শুধু বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতাই নয়, দিন তিনেক লন টেনিস খেলারও সুযোগ হয়েছিল। বেশি বয়স এবং স্বাস্থ্য ততটা ফিট ছিল না বলে প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক একটু এগিয়ে পিছিয়ে বল ভাল মারতেন। আমরা উপভোগ করতাম। কিন্তু তখন কথাটি আমার মনে একবারও উদয় হয়নি যে এই ভদ্রলোক সব জায়গায় নিজেকে অত্যন্ত কূটকুশলী খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করতে পারবেন। সবাইকে নাকনিচুবানি খাওয়াতে পারবেন। যে দলটির পছন্দের লোক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন তাদের বিরুদ্ধেই টেনিস খেলায় ব্যবহৃত ভলি, ব্যাকহ্যান্ড, এ্যাংগুলার শটসহ বিধ্বংসী সার্ভিস ‘এইস’ নিয়ে তাদের ধরাশায়ী করবেন এ কথা কারও বোঝার উপায় ছিল না। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে একজন বিচারপতির নিরপেক্ষতাই প্রত্যাশা করেছিল এবং তারা মনে করেছিল তাহলেই তাদের বিজয় নিশ্চিত। এই দেশে সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের হৃদয়ের গভীরে লালিত একটি স্বপ্নসাধ এবং তা অর্জনে অনেক রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে। তারপর এখন কেন এই বিতর্ক উঠেছে! তৃতীয় ও শেষ বা চতুর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতা, স্বৈরাচারী মনোভাব ও পক্ষপাতমূলক আচরণই এর জন্য দায়ী। প্রথম ও দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সাধারণ মানুষ কোন কথা বলেনি। কারণ, ওই দুটি সরকার দায়িত্ব পালনে ছিল সৎ ও আন্তরিক। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। তবে বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের প্রতিরক্ষা দফতর সংক্রান্ত একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং অপর ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগের আগেই গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে রদবদল তখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, গণবদলির তুঘলকি কর্মকা-ে প্রথম মাসেই অতিরিক্ত আইজিপি থেকে থানার ওসি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় শ’ বিভিন্ন স্তরের পুলিশ অফিসার বদলি করা হয়েছিল। প্রশাসনে সচিব থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ শ’ পদে রদবদল করা হয়েছিল। আর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল। তারা শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেই চায়নি, তাদের আচার-আচরণে স্বৈরাচারী মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আর তাই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখন আন্দোলন-সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধী হয়ে উঠেছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাবে জনগণ খুশি হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে জনগণ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত বলে মনে করছে। বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি যদি মনেপ্রাণে চায় দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তাহলে তাদের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অবিলম্বে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা, অংশীদারিত্ব কিভাবে নির্ণয় হবে এবং কার ভূমিকা কি থাকবে তা সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিতকরণসহ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা হতে পারে। নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে আলোচনায় আসতে পারে। সংলাপ ছাড়া সঙ্কটের সমাধান কোনমতেই সম্ভব নয়। লক্ষ্য যদি সমস্যার সমাধানই হয়, তাহলে সবাইকে মন খোলাসা করে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আলোচনায় বসতে হবে। শুধু শুধু জনগণের কথা বলে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। জনগণ সমস্যার সম্মানজনক সমাধানের দিকেই তাকিয়ে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে তাঁর শক্ত অবস্থান থেকে সরে এসে প্রশংসিত হয়েছেন। এখন বিরোধী দলকে এগিয়ে আসতে হবে। যাতে একটা সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া যায়। অন্যথায়, অনেকের আশঙ্কা মোতাবেক অগণতান্ত্রিক শক্তি যে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে সেদিকে সবার খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সংঘাতের পথ ছেড়ে সমঝোতার পথে এগোতে হবে। সঙ্কট নিরসনে ছাড় দেয়ার মহানুভবতা প্রদর্শনের মানসিকতাই হতে পারে আগামী নির্বাচনে জয়লাভের মোক্ষম অস্ত্র। যেমন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড় দিয়ে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করে জনগণের বিবেচনায় তিনি অনেকটাই এগিয়ে গেছেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.