শেয়ারবাজার : আমায় একলা থাকতে দে by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ স্বাভাবিক গতিতে চলছে। এ কথা মেনে নিতে বা বুঝতে হলে গত ২৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হবে। ১৯৮৭-৮৮ সালে কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ৩৪ শতাংশ শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। ফলে শেয়ারবাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায়।


তারপর আবার দরপতন শুরু হয়। সে সময় ডিএসইর বড় সহযোগী ছিল ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। আইসিবির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেকান্দার ডিএসই ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শেয়ারবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তখন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) জন্ম হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিনিয়োগ শাখা দেখভাল করত। একজন যুগ্ম সচিব কন্ট্রোলার অব ক্যাপিটাল ইস্যুজ হিসেবে খবরদারি করতেন। ১৯৯২ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। শেয়ারবাজার ক্রমেই সক্রিয় হতে থাকে। এ অবস্থায় কিছু বিধিনিষেধ থাকা উচিত ছিল। যে কারণেই হোক তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সেটি করেননি। পরে যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে এই সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর দেশি বিনিয়োগকারী বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, তখন তিনি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর লকইন আরোপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখেন। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। যেহেতু তাদের সম্পর্কে সমাজতন্ত্রপ্রীতির একটা ধারণা পোষণ করত, তাই তারা এটা দূর করার জন্য বেশি মাত্রায় মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। যাকে বলা হয় রোমানদের চেয়েও বেশি রোমান। লকইন উঠিয়ে দেওয়া হলো। সুপ্ত বাসনা পূরণ করার জন্য কিছু উদ্যোক্তা ও ব্রোকার উঠেপড়ে লাগল। শুরু হলো নানা ধরনের কারচুপি। ১০০ টাকা মূল্যের শেয়ারের দাম উঠল ২৫ হাজার টাকা। চলল মহা-উন্মাদনা। তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো। মহাপ্রলয় ঘটল। বিশ্বখ্যাত অর্থনৈতিক সাপ্তাহিকী The Economist-এ বলা হলো, Slaughter of the Innocent. ১৯৯৬ সালের এই বিপর্যয়ের সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন এস এ এম এস কিবরিয়া। তিনি বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত করিয়েছিলেন। অন্যান্য পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে এবং আবার সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হন। শত প্ররোচনার মুখে তিনি নির্লিপ্ত থাকেন এবং শেয়ারবাজার তার নিম্নগতিতে চলতে থাকে। স্টক এক্সচেঞ্জের ম্যান্ডারিন ও এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এবং সেই সঙ্গে মিডিয়ার একটা অংশ শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিটাকে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করতে চান। শেয়ারবাজারে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় হয়। তাহলে তার একটা সরবরাহ লাইন আছে। কোথাও পণ্যটি উৎপাদিত হয়ে বাজারে আসতে হবে। শেয়ারবাজারের উৎপাদনভূমি হলো আইপিও বা প্রাথমিক মার্কেট। মূলত শিল্প খাত শেয়ারবাজারের সরবরাহের অন্যতম উৎস। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্প এই খাতের প্রধান। অথচ গার্মেন্ট শিল্প খাত থেকে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার মার্কেটে এসেছে। সরকারের হাতে যেসব শেয়ার রয়েছে, তার একটিও বাজারে আসেনি। ওষুধ শিল্প এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এবং বহির্বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে। বৃহৎ দুটিসহ বেশ কয়েকটি ওষুধ শিল্প বাজারে আছে। কিন্তু বিভাগীয় একজন সদস্যসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা এখনো বাজারে আসছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানি করা হয়েছে, অথচ বাজারে কোনো শেয়ার ছাড়া হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যাংক ও বীমা কম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লাইসেন্স প্রদানের শর্তাবলির অন্যতম হলো যে বাজারে শেয়ার ছাড়তে হবে। তারা না এলে বাজারের অবস্থা করুণ হতো। সরকারি তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট যে বিনিয়োগ হয়, সেখানে আইপিও মার্কেটের অবদান ১ শতাংশও নয়। এককথায় বলা চলে, আইপিও মার্কেট বস্তুত স্থবির। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণের সঞ্চয়ের ওপর চাপ বাড়ছে। পুরো বিষয়টি সামগ্রিকভাবে না দেখে একদল আঁতেল শেয়ারবাজারকে অত্যন্ত সক্রিয় দেখতে চায়। আমি আগেই উল্লেখ করেছি এর ভেতর কারা রয়েছে। অর্থনীতি সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান থাকলে কেউ কি এ রকম ধারণা পোষণ করবে যে শেয়ারের দাম বাড়তেই থাকবে এবং আকাশ হলো সীমারেখা। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখেই বর্তমান শেয়ারবাজার চলছে। এতে কোনো গোদ হয়নি যে অস্ত্রোপচার লাগবে। কিন্তু ইতিমধ্যে নানা ধরনের অপতৎপরতা চলছে। এক শ্রেণীর জ্ঞানী ব্যক্তি বলছেন, তারল্য সংকট চলছে। প্রথমেই বলতে হয়, ধারের টাকায় শেয়ার কেনা অবশ্যবর্জনীয়। বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারের জন্য একটি ঋণই স্বীকৃত, তা হলো মার্জিন ঋণ, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকে মার্চেন্ট ব্যাংক। শেয়ারবাজারের মতো অনুৎপাদনশীল ব্যবসায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তা করা হলে কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে শেয়ার মুখ থুবড়ে পড়বে । বর্তমান সরকার, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছে যে তাদের ভুলের জন্য আওয়ামী লীগের ললাটে কলঙ্কের তিলক এঁকে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে এসইসি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী। তারা নিশ্চয়ই স্টক এক্সচেঞ্জের মার্কেটিং এজেন্ট। নয়া এসইসির একজন সদস্য অর্বাচীনের মতো বলেছেন, যা এসইসি রেগুলেটর নয়, ফ্যাসিলিটেটর। এসব মোটা বক্তৃতা এসইসির কর্মকর্তাদের মুখে শোভা পায় না। বিশ্বব্যাপী সবাই জানে যে এসইসি রেগুলেটর বিশ্বের প্রথম নিয়ন্ত্রক সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসইসি। তারা কিভাবে কাজ করছে এটা একটু দেখার চেষ্টা করা দরকার। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে ঘরে বসে সব দেখা যায়। এ জন্য সব সময় গিয়ে দেখার প্রয়োজন হয় না। ঘটনাচক্রে বড় দুটি শেয়ার কেলেঙ্কারি আওয়ামী লীগের দুদফা শাসনকালে ঘটল। বর্তমান সরকারের আয়ু আর বোধ হয় ১৪-১৫ মাস। আশা করি, এসইসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অজ্ঞতা বা অদক্ষতার কারণে কেলেঙ্কারির হ্যাটট্রিক যেন না হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। অর্থ মন্ত্রণালয়ের গায়ে পড়ে এই কলঙ্কের তিলক আঁটায় যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে, তা সময় বলে দেবে। এই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, যদি যেসব ব্যক্তির জড়িত থাকার উল্লেখ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। Impunity culture একটি বড় ধরনের ক্ষত। এ থেকে জাতির আরোগ্য লাভ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার খুব স্বাভাবিক গতিতে চলছে। আগেই বলেছি যে এর উন্নতি করতে চাইলে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে হবে। প্রাইমারি মার্কেট ও সেকেন্ডারি মার্কেটকে সমান্তরাল গতিতে চালাতে হবে। কিছুসংখ্যক শেয়ার ব্রোকার ও উদ্যোক্তার হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যেন শেয়ারবাজারের ওপর অনৈতিকভাবে চাপ দেওয়া না হয়। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে দিন দিন। এমনকি এলিট ডিগ্রিধারী বিবিএর ভেতরও বেকার রয়েছে। তাঁদের উপার্জন করানোর নামে নানা ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। শেয়ারবাজারকে সক্রিয় করার মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান হবে- এ রকম পাগলের প্রলাপও শুনতে হয়েছে আমাদের। আর নয়, এর ইতি টানা প্রয়োজন। তাইতো একটি রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম পঙ্ক্তিতে একটু সংযোজন করে শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছি শেয়ারবাজারকে চক্রান্তের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.