স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন- যুবলীগ নেতা তুষারকে গুমের ঘটনায় র‌্যাব জড়িত by রোজিনা ইসলাম

যুবলীগের নেতা ও কাপড় ব্যবসায়ী তুষার ইসলাম টিটুর নিখোঁজ ও গুম হওয়ার ঘটনার জন্য র‌্যাবকে দায়ী করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। চার বছর আগে সিরাজগঞ্জ থেকে তুষারকে ঢাকার র‌্যাব-৩-এর সদস্যরা আটক করেছিলেন বলে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।


তদন্ত প্রতিবেদনে তুষারের নিখোঁজের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তুষারকে আটক করার পর বর্তমানে তাঁর অবস্থান কোথায়, সে সম্পর্কে তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবহিত করার জন্য র‌্যাব কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি গত মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবেদনটি গত ২৭ জুলাই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সি কিউ কে মুস্তাক আহমেদ গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অনুসন্ধানে যেহেতু প্রমাণ হয়েছে, র‌্যাব এ ঘটনার জন্য দায়ী, সেহেতু অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তদন্ত প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে র‌্যাব কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রতিবেদন নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর আগে বাপ্পী, আরিফ ও বাবু হত্যার বিষয়ে র‌্যাবকে দায়ী করে এ ধরনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল, এসব প্রতিবেদনে আমাদের কিছুই যায়-আসে না।’ তিনি দাবি করেন, কিছু মানবাধিকার সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে, যার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। আর তদন্ত কমিটিতে র‌্যাবের কোনো সদস্য ছিল না, তাই প্রতিবেদনটি নিরপেক্ষ হয়নি র‌্যাবের এই কর্মকর্তার কাছে।
নিখোঁজ তুষার যুবলীগের ঢাকা মহানগরের (দক্ষিণ) ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে, থাকতেন ঢাকার খিলগাঁওয়ে। ২০০৮ সালের ২২ আগস্ট নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তুষারের পরিবারের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছিল, তাঁকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে।
সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হলে এই ব্যাপারে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০০৯ সালের ৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি হয়। কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন ২০১০ সালের ৩ জুন মানবাধিকার কমিশনে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রতিবেদনটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় একজন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করানোর জন্য মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে ২০১০ সালের ২২ জুলাই। কিন্তু মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর কমিশন চলতি বছরের মে মাসে পুনরায় এ বিষয়ে তদন্ত করার অনুরোধ জানালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন ও পরিকল্পনা) শওকত মোস্তফাকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি সাতজন সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য এবং আনুষঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
তুষারের বোন শাহনাজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরও ধারণা, তুষারকে র‌্যাব হত্যা ও গুম করেছে। তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে এখন আমার শুধু একটাই অনুরোধ, যদি ওকে মেরে ফেলা হয়ে থাকে, তাহলে দয়া করে আমাদের বলুন, লাশটা ফেরত দিন।’
যেভাবে নিখোঁজ হন: তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার বিবরণে বলা হয়, ২০০৮ সালের ২২ আগস্ট তুষার তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা ধুকুরিয়া বেড়া বাজারে যান। সেখানকার মকবুল স্টোর থেকে তাঁকে সাদা পোশাক পরা র‌্যাব-৩-এর সদস্যরা আটক করেন। তারপর র‌্যাব সদস্যরা আবদুল মান্নানের নছিমন ভ্যানে করে তুষারকে মুকুন্দগাতি বাজারে নিয়ে যান। সেখান থেকে দুজন স্থানীয় ব্যক্তির কাছ থেকে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে একটিতে তুষারকে বসিয়ে র‌্যাব সদস্যরা অন্যত্র চলে যান। এর পর থেকে তুষারের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা র‌্যাব-৩-এর কার্যালয়ে গিয়ে খোঁজ করলে তুষারকে আটক করার কথা অস্বীকার করে র‌্যাব। পরিবারের সদস্যরা খিলগাঁও থানা ও বেলকুচি থানায় এ ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত র‌্যাবের পাঁচ কর্মকর্তা ও সাক্ষীদের বক্তব্য থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, র‌্যাব-৩-এর একটি দল তুষারকে ওই দিন আটক করেছিল। ধুকুরিয়া বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী হাসমত আলী তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, তিনি দেখেছেন, তুষারকে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় চারজন র‌্যাব সদস্য ভটভটিতে উঠেয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আর ‘আল্লাহর দেওয়া ভান্ডার’ নামের দোকানের মালিক দেখেছেন, নছিমনের ভেতরে পিস্তলসহ ‘সিভিল পোশাকে’ পাঁচজন র‌্যাব সদস্য, মাঝখানে তুষার বসা। সেখানে তাঁরা ২০ থেকে ২৫ মিনিট অবস্থান করে দুটি মোটরসাইকেলে করে তুষারকে নিয়ে চলে যেতে দেখেছেন।
বাজারের দুই ব্যবসায়ী সাইফুল আলম ফারুক ও আশরাফ আলী জানিয়েছেন, তুষারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য র‌্যাবের সাদা পোশাক পরা সদস্যরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে তাঁদের কাছ থেকে দুটি মোটরসাইকেল ফেরত দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যান। তাঁরা এ বিষয়ে বেলকুচি থানায় জিডি করেন। পরদিন বেলকুচি থানা থেকে তাঁদের মোটরসাইকেল ফেরত দেওয়া হয়।
জড়িত র‌্যাব সদস্যরা: তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, তুষারকে ধরে নেওয়ার ঘটনায় র‌্যাবের পাঁচ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। তাঁরা হলেন: বর্তমানে র‌্যাব-৩-এর উপসহকারী পরিচালক মো: হানিফ, সহকারী উপপরিদর্শক ফিরোজ আহমেদ (এখন পুলিশের বিশেষ শাখায়), কর্পোরাল আমিন উল্লাহ অপু (বর্তমানে বিমানবাহিনীর ইঞ্জিন ফিটার), সহকারী উপপরিদর্শক হুমায়ূন ফরিদ (এখন মুন্সিগঞ্জ থানায়) ও মোখলেসুর রহমান (এখন র‌্যাব-২-এর উপসহকারী পরিচালক)।
তদন্তের ফলাফল: তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, র‌্যাবের সদস্যরাই তুষারকে আটক করেছেন—এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। তুষার যেদিন ধুকুরিয়া বেড়া বাজার থেকে আটক হন, ওই দিনই তাঁকে দুটি মোটরসাইকেলে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন র‌্যাব সদস্যরা। পরদিন র‌্যাব-৩ কর্তৃপক্ষ মোটরসাইকেল দুটি বেলকুচি থানায় জিডির মাধ্যমে হস্তান্তর করে। তবে র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা তুষারকে আটক করার কথা তদন্ত কমিটির কাছে অস্বীকার করেন। তাঁরা দাবি করেন, ধুকুরিয়া বেড়া বাজার থেকে কোনো লোককে আটক করে তাঁরা ঢাকায় আনেননি। কিন্তু বেলকুচি থানায় দুটি জিডি (নম্বর ৬৫৬ ও ৬৮০) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, র‌্যাব সদস্যরা একজন আটক ব্যক্তিকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য জিডিতে উল্লিখিত মোটরসাইকেল দুটি ব্যবহার করেছেন এবং পরে তা থানায় জমা দিয়েছেন। তাই তদন্ত কমিটির কাছে র‌্যাব যে বক্তব্য দিয়েছে, তা সঠিক নয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগের নেতা তুষার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কয়েক দিন আগে একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, তুষারকে র‌্যাবের সদস্যরাই আটক করেছেন। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী র‌্যাবের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা জরুরি। এ বিষয়ে আমরা দু-এক দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত র‌্যাবের কর্মকর্তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুপারিশ করব।’

No comments

Powered by Blogger.