পাকিস্তান- হেমন্তে সমঝোতার অপেক্ষায় by নাজাম শেঠি

পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি বেঞ্চ প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফকে ২৭ আগস্ট আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি লিখবেন, এই মর্মে আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে।


তা না করলে তিনি তাঁর পূবসূরির মতো সংসদ সদস্য হিসেবে অযোগ্য বলে ঘোষিত হবেন। অর্থাৎ এর আগের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির মতো তিনিও প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাবেন।
অধিকাংশ সংবিধান-বিশেষজ্ঞ ও আইন-বিশারদ বলাবলি করছেন ঘটনা পরিষ্কার: ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখতে নারাজ, সুপ্রিম কোর্টও ছেড়ে দিতে রাজি নয়। সুতরাং, আরেকজন প্রধানমন্ত্রীকে অচিরেই তল্পিতল্পা গোটাতে হচ্ছে। রাজনৈতিক পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলছেন, এটা হলো ‘সমাপ্তির সূচনা’। কারণ, কলঙ্কিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জটাজালে আটকা পড়ায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের রাস্তা খুলে গেছে, যার ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ‘গণতন্ত্র’।
আমি বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করতে চাই। সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে যা চলছে, তা কোনো সাংবিধানিক বা আইনি সংকট নয়। এই রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ—রাষ্ট্রের দুটি অঙ্গের মধ্যে রাজনৈতিক রশি টানাটানি। ক্ষমতাধর ও উচ্চাভিলাষী দুজন ব্যক্তি এটা পরিচালনা করছেন। এই রশি টানাটানিতে দেশের আইন ও সংবিধানকে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে, এমনকি তুচ্ছ কারণেও বিকৃত করা হচ্ছে।
এক পক্ষের প্রধান চালিকাশক্তির কাজ করছেন ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি। আর অন্য পক্ষে আছেন আসিফ আলী জারদারি নামের এক ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি। প্রথম ব্যক্তির ক্ষমতার উৎস সুপ্রিম কোর্ট নামের প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একজন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের এক সফল আন্দোলনের বিদ্রোহপূর্ণ ইতিহাস। দ্বিতীয় ব্যক্তির শক্তির উৎস রাষ্ট্রপতি নামের প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দুজন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে পিপিপির শহীদদের ইতিহাস। প্রথম ব্যক্তি অসাধারণ ‘বিচার বিভাগীয় তৎপরতা’র (জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজম) মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা ও অপরিহার্যতার পরিধি সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন; তাঁর ওই সব তৎপরতা আসলে নিরাবরণ রাজনৈতিক পপুলিজম। দ্বিতীয় ব্যক্তি চেষ্টা করছেন জাতীয় পর্যায়ের একটি রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক জায়গাটুকু ধরে রাখতে। সে দলটি কেবল তার চিরাচরিত দুই শত্রু যথা সামরিক বাহিনী ও পাকিস্তান মুসলিম লিগের বিরোধিতার মুখোমুখিই নয়, তার আরও কিছু নতুন শত্রু দাঁড়িয়ে গেছে, যথা: সংবাদমাধ্যম, বিচার বিভাগ ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত ইমরান খান।
উভয়েই উপলব্ধি করতে পারছেন, প্রতিপক্ষের মতলব সম্পর্কে হিসাব-নিকাশে ভুল হলে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, কোনো না কোনো দিক থেকে তাঁরা উভয়েই ব্যক্তিগতভাবে নাজুক। ইফতিখার চৌধুরীর দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলের জন্য জনগণের মধ্যে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জনগণ মনে করছে, তাঁর বিচারগুলো পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ছে। অন্যজন, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা হচ্ছে ব্যাপক দুর্নীতির জন্য, যার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান অসহনীয় মাত্রায় নিচে নেমে গেছে।
এই পরিস্থিতির যুক্তি উপেক্ষা করা যায় না। আবারও একজন প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় নিতে হলে জনমনে তাঁদের সম্পর্কে ধারণা আরও খারাপ হয়ে যাবে। প্রাতিষ্ঠানিক ‘নীতি’র একটি বিষয় পরিণত হবে অতিমাত্রায় ব্যক্তিগত প্রকৃতির বৈরীতে। জবাই হওয়ার জন্য তৃতীয় একজন প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়নের অর্থ দাঁড়াবে জনগণের ধৈর্যশক্তি নিয়ে তামাশা করা, সে রকম হলে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও উভয় প্রতিপক্ষকেই মাশুল গুনতে হবে। দুজনের কেউই চাইবেন না পরিস্থিতি সেদিকে এগিয়ে যাক। তাঁরা চাইবেন না, তাঁদের নিজেদের লোকজনের মধ্যেই বিভেদ সৃষ্টি হোক, যার ফলে তাঁরা নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়বেন।
এই মুহূর্তে সাধারণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারণের ইচ্ছার ওপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়া এই সমস্যার সমাধান নয়। জারদারির জন্য সেটা হবে একটা রাজনৈতিক বিপর্যয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়বদ্ধ থাকবে একজন স্বাধীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে, আর আদালত প্রভুত্ব করবেন নির্বাচন কমিশনের ওপর—এই পরিস্থিতিতে জারদারি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। তখন সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে সেই চিঠি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার লিখবে তো বটেই, আদালত যেভাবে বলে দেবেন, অক্ষরে অক্ষরে ঠিক সেভাবে লিখে পাঠিয়ে দেবে।
অন্তর্বর্তীকালীন এ রকম আয়োজনের চেয়ে অনেক ভালো একটা সমাধান আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই অনিবার্য হয়ে উঠবে।
আদালত বলে চলেছেন, সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখতেই হবে, এই ‘নীতিগত’ অবস্থান থেকে আদালত নড়বেন না। কিন্তু আদালত নানাভাবে এটাও স্বীকার করেছেন, কোনো ধরনের বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে রাষ্ট্রপতির দায়মুক্তির অধিকার আছে এবং একটা মধ্যপন্থা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। হতে পারে, চিঠিটি এমন ভাষায় লেখা হবে, যাতে এক পক্ষের নীতি রক্ষিত হয়, অন্য পক্ষের স্বার্থ রক্ষিত হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, এটা কীভাবে করা যায় তিনি খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু এখন কোনো পক্ষই কোনো ধরনের দুর্বলতা দেখাতে চাইছে না এই ভেবে যে, অন্য পক্ষ সেই দুর্বলতার সুযোগ নেবে।
তাই যখন আলাপে সুবিধা তখন আলাপ, আর যখন লড়তে সুবিধা তখন লড়াই—বিরোধ নিষ্পত্তির এই কৌশলই চলছে আগোড়া।
সরকার আদালতের রায়ের ব্যাপারে একটা রিভিউ পিটিশন দাখিল করার মধ্য দিয়ে আদালতকে আলোচনায় টেনে আনার চেষ্টা করছে। আদালতের পথ রুদ্ধ করতে সরকার রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশও জারি করতে পারে। সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকদের বিচারকদের বিরুদ্ধে, তাঁদের রায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামাতেও পারে। আদালত তখন আদালত অবমাননার অভিযোগ করবেন, সরকারের রিভিউ পিটিশন ও রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশকে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দেবেন।
কিন্তু ২৭ আগস্ট তারিখটা পাথরে খোদাই করা হয়নি। হেমন্তকাল আসুক, আপস-মীমাংসার নানা দিক তখন পরিষ্কার হবে। উভয় পক্ষই দাবি করতে পারবে, তাদের জয় হয়েছে। এক পক্ষ দেখবে, শেষ পর্যন্ত চিঠিটি লেখানো গেছে, সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ মর্যাদা রক্ষা পেয়েছে। অন্য পক্ষ দেখবে, আদালত অত দূর পর্যন্ত যেতে পারেননি, যেখানে শহীদ নেতাদের কবর থেকে তুলে এনে রাস্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হতো আর তার মধ্য দিয়ে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ অন্য পথে চলে যাওয়ার রাস্তা তৈরি হতো।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাজাম শেঠি: পাকিস্তানের ইংরেজি সাপ্তাহিক ফ্রাইডে টাইমস-এর সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.