ঈর্ষণীয় সফলতাই মুজিব হত্যার কারণ by সরদার সিরাজুল ইসলাম

(পূর্বপ্রকাশের পর) শেখ মুজিব সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছিলেন। জনগণের মধ্যে তার ভাবমূর্তি তখন পর্যন্ত ছিল গগণচুম্বী। নির্বাচনে অবতীর্ণ হলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। সে কারণেই ক্ষমতা হারানোর ভয় তার ছিল না। কাজেই নিছক ক্ষমতায় থাকার জন্য সিস্টেম পরিবর্তনে উদ্যোগী হননি।


জাতির জনক হিসেবে জনগণের কাছে প্রত্যিশ্রুত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের প্রয়োজনে তিনি প্রশাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
মওদুদ আহমদের গ্রন্থ শেষ হয়েছে এভাবে
ওঃ রং গঁলরন যিড় রহ ঃযব বহফ ধিং ধনষব ঃড় রফবহঃরভু যরসংবষভ হড়ঃ ড়হষু রিঃয ঃযব পধঁংব ড়ভ ঃযব ইবহমধষরং নঁঃ রিঃয ঃযবরহ ফৎবধসং ....
ওঃ ংববসং ঃযধঃ গরঁলরন পধসব নধপশ ভৎড়স ঃযব ঢ়বফধংঃধষ ড়ভ ধহ রসসড়ৎঃধষ নবরহম ড়হষু ঃড় ফরব ভড়ৎ ংধারহম ঃযব রহফবঢ়বহফবহপব ভড়ৎ যিরপয যব ংঃৎঁমমষবফ. রঃ রং ঃৎঁব ঃযধঃ গঁলরন ভধপবফ ধ ঃৎধমরপ ফবধঃয নঁঃ যব ষবভঃ ইধহমষধফবংয ভৎবব ধহফ রহফবঢ়বহফবহঃ. অষঃযড়ঁময ঃযধঃ ফবধঃয পধসব ভৎড়স যরং ড়হি সবহ ধহফ রহ ধ নৎঁঃধষ ভৎড়স, পড়ঁষফ গঁলরন হড়ঃ রহ ঃযরং ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ পড়হঃবীঃ নব পধষষবফ ধ গধৎঃুৎ? (মওদুদ আহমদরা এ কথা পল্টনে বলেন না)।
বঙ্গবন্ধু যে ব্যবস্থার মাধ্যমে তার দুঃখী সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন এবং দীর্ঘ দিনের লালিত সংগ্রামের ফসল সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রবর্তন করেছিলেন তা ছিল সমাজ বিবর্তনে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার লক্ষ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন (ট্রানজিসন পিরিয়ড) সময়ের জন্য। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনীর ভাষা থেকে। জাতীয় দল গঠনের অভিপ্রায় ব্যক্ত উক্ত সংশোধনীতে (ধারা ১১৭-এ) বলা হয়
“রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে অনুচ্ছেদ-২এ বর্ণিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার (চার মূলনীতি) যে কোন একটি পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তা হলে তিনি একটি মাত্র জাতীয় দল গঠনের নির্দেশ প্রদান করবেন।
সংশোধনীর এই ভাষা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি জাতীয় দল গঠনে ব্রতী হন। উল্লেখ্য, সমাজতন্ত্রী দেশে একটি মাত্র দল থাকে। তবে রাষ্ট্র মৌলিক প্রয়োজনের দায়িত্ব নেয়। লক্ষণীয়, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন তাহলে একদল করার ক্ষমতা তাকে দেয়া হলেও ভবিষ্যতে নির্ধারিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরে আবার তিনি যখন মনে করবেন যে একদলের আর প্রয়োজন নেই তখন একাধিক দলগঠনের নির্দেশও তিনি প্রদান করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা এবং জাতীয় দল গঠন করেছিলেন জনগণের নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এবং এতে দলে দলে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল। ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যে ৭ জন বাদে সবাই বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন (পূর্বকোণ ২৯ জুন, ১৯৯১)। জিয়া শুধু বাকশালে যোগই দেননি বরং বাকশাল ডিজিগনেট গভর্নরদের লিখিত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন (১৯ জুলাই, ৭৫ তারিখে পাবনার অধ্যাপক আবু সাইদকে লেখা পত্র ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-, পৃষ্ঠা ২৫৭ দ্রষ্টব্য)। কমিউনিস্ট নেতা মণি সিং, হাজী দানেশ বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আগস্ট ’৭৫-এর তৃতীয় সপ্তাহে কমরেড তোহার বাকশালে যোগদানের কথা ছিল (তারকালোক ১৫-৩০ ডিসেম্বর ’৮৭) এখন কট্টর সমালোচক এনায়েতুল্লাহ খান শুধু বাকশালে যোগ দেননি, বরং প্রেস সংক্রান্ত ব্যবস্থাবলী (পত্রিকা নিয়ন্ত্রণসহ) প্রণয়েরে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, চারটি পত্রিকা রেখে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বেকার করে দেন বলে যে অপপ্রচার চালানো হয় তা বস্তুনিষ্ঠ নয়। কেননা এদের সবাইকে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসনে চাকরির ব্যবস্থা করেন এবং সে সুবাদে অনেকেরই কপাল খুলে গেছে। প্রশাসনে উঁচু এবং আকর্ষণীয় পদে বহাল ছিলেন অনেক ফকির এখন বাদশা। এ প্রসঙ্গে নির্মল সেন ও গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাক্ষাৎকার সাপ্তাহিক মেঘনা ১৩ আগস্ট ৬৭ ও ১৪ জুন ৬৭ দ্রষ্টব্য। মওলানা ভাসানীও সমর্থন জানিয়েছিলেন বাকশালকে (শেখ মুজিব শাসনকাল পৃষ্ঠা ৩৪৯)।
বঙ্গবন্ধু গণমুখী পদক্ষেপসমূহ শুধু বিদেশী নয়, দেশীয় শোষক শ্রেণীকে আতঙ্কিত করে তোলে। এদের মধ্যেÑ
ক) ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সংখ্যায় নাগরিকত্ব-সম্পত্তি হারানো ব্যক্তিরা।
খ) ধর্মের নামে যাদের রাজনীতি ব্যবসায় বন্ধ করা হয়েছিল।
গ) রাষ্ট্রীয়করণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা।
ঘ) জমির সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা সিলিং নির্ধারণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভূস্বামীরা।
ঙ) গোলাম আযম, হামিদুল হক চৌধুরীসহ পাকবাহিনীর যে সব নেতৃস্থানীয় দোসরকে নাগরিক হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল সেই ৩৯ ব্যক্তি।
চ) যে ৮৪ জন পদস্থ কর্মকর্তার চাকরি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং
ছ) যদিও বঙ্গবন্ধু সকল সাংবাদিককে নিয়মিত বেতন-ভাতা এবং উপযুক্ত সরকারী চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা রেখে পত্রিকা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তবুও পত্রিকা মালিকরা সম্পত্তি হারিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি সফল হয়নি, তবে এর প্রাথমিক পদক্ষেপের মধ্যে ৪ মূলনীতির ভিত্তিতে ঐ জাতীয় ঐক্য, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়াও দুর্নীতি উচ্ছেদ এবং প্রস্তাবিত বাধ্যতামূলক সমবায় ব্যবস্থায় যথাক্রমে সরকারী কর্মচারী, লুটেরা ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়। লুটপাট বন্ধ, চাকরি হারানো এমনকি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ভয়ে। ভূস্বামী জমি হারানোর ভয়ে। জেলা গভর্নরদের অধীনে আমলাদের নিয়োগও ব্যুরোক্রাসীকে শঙ্কিত করে। চুরি ডাকাতির জন্য থানাদারকে (ওসি) দায়ী, শহরে ৫ কাঠার ওপর একটির বেশি বাড়ি না থাকার বিধানও সংশ্লিষ্ট সবাইকে আতঙ্কিত করে। সমাজের এসব প্রভাবশালীদের সম্মিলিত উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। একমাত্র মুজিবই এ দেশের দুঃখী মানুষের ভাত কাপড়ের জন্য নিজের জনপ্রিয়তার ঝুঁকি (স্টেটসম্যান) নিয়ে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শোষণের প্রক্রিয়াকে যতখানি ভাঙতে চেয়েছিলেন তার কিছুটা ভেঙ্গেছেন, তবে দিয়েছিলেন প্রচ- ঝাঁকুনি। কি করতে পেরেছেন, যদিও তুলনামূলকভাবে তা অসামান্য নয় তবে সেটাই বড় কথা নয়। গভীর দৃষ্টি দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় এনে দেখতে হবে তিনি কি করতে চেয়েছিলেন। তা কার্যকর করতে পারেননি সময়ের অভাবে। তার আন্তরিকতার সন্দেহ পোষণ করা হবে বড় ধরনের পাপ। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী সরদার ফজলুল করিম যথার্থই বলেছেন, শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। সব দিকে বড়, তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালবাসায় এবং দুর্বলতায়। সবদিকে এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে, ঈর্ষাপীড়িত হয়ে ঈষিতের স্থান দখল করা যায় না। তাইতো এই ভূখ-ে মুজিবের স্থায়ী অবস্থান মধ্যগগনে এবং তার নাম শুনে শোষকের সিংহাসন কাঁপে। (সমাপ্ত)
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.