দিনে ৫ হাজার কোটি টাকার জাল নোট ঘোরে বাজারে by পারভেজ খান

চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার এক পাইকারি হেরোইন ব্যবসায়ীর নাম মুকুল ঘাটিয়াল। তার অভিজ্ঞতার কথা আগে শোনা যাক। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর অন্যতম চোরাচালানের ঘাট ভাঙ্গাব্রিজ এলাকা হয়ে সে ওপারে যায়। নৌকায় পদ্মা পার হয়ে ভারতের লালগোলা, সেখান থেকে বাসে চেপে বহরমপুর।


সেখানেই তার হেরোইনের কারবার। তবে তাদের লেনদেন হতো হেরোইন কিনে ফেরার পথে নদীতে নৌকায় বসে। ভিনদেশি বিক্রেতা তাকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। তিন কেজি হেরোইন কেনে সে এক কোটি টাকায়, এ দেশে যার বাজারমূল্য কমপক্ষে তিন কোটি টাকা। লেনদেন হয় ৫০০ টাকার নোটের বান্ডিলে। এরপর ভাঙ্গাব্রিজ ফিরে মুকুল ঘাটিয়াল এই হেরোইন তুলে দেয় পুরান ঢাকার পাইকারি হেরোইন ব্যবসায়ী জ্যোৎস্নার কাছে, দাম আদায় করে দেড় কোটি টাকা। সন্ধ্যায় মাটির ঘরের বারান্দায় হালকা আলোয় বসে লেনদেন। জ্যোৎস্না চলে যায় হেরোইন নিয়ে। গভীর রাতে টাকার হিসাব মেলাতে বসে মুকুল দেখে, দেড় কোটি টাকার মধ্যে এক কোটি ৪৫ লাখই জাল, সবই ৫০০ টাকার নোট। জাল টাকার বান্ডিলের প্রথম আর শেষের দিকে কিছু আসল নোট রেখে বানানো হয়েছে এই বিশেষ বান্ডিল। সেটায় সুতো দিয়ে গেঁথে ব্যাংকের সিলমোহর দেওয়া স্লিপ পর্যন্ত সাঁটানো। পরে জানা যায়, ওই সিলমোহরও জাল। এরপর জ্যোৎস্নাকে ধরার জন্য মাঠে নামে মুকুল ঘাটিয়াল। মাস তিনেক পরে ধরেও ফেলে। টাকা ফেরত দেয় জ্যোৎস্না। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, জ্যোৎস্না ওই জাল টাকা কেরানীগঞ্জের কিসমত ওরফে কামাল নামের একজনের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকায় কিনেছিল।
ইদানীং দৈনিক পত্রিকাগুলোয় একটি বিজ্ঞাপন সবার নজর কাড়ছে। সেটা হচ্ছে, জাল নোট থেকে সাধারণ মানুষকে সাবধান করে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচারণা। এতে জাল নোট শনাক্ত করার নানা উপায় বাতলে দেওয়া হচ্ছে। এতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে জাল টাকা নিয়ে দেশবাসীর দিশেহারা অবস্থা চলছে। গোয়েন্দাদের তদন্তে বের হয়ে এসেছে, ঢাকায় অর্ধশতসহ সারা দেশে দুই শতাধিক সংঘবদ্ধ চক্রের প্রায় ৩০ হাজার লোক জাল টাকার কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়া অন্য দেশ থেকেও জাল টাকা মুদ্রিত হয়ে আসছে। বছরজুড়ে তো চলেই, তবে রোজার ঈদের আগের সময়টা এ কারবারের বলা যায় 'ভরা মৌসুম'। আর এই কারবার যে শুধু সাধারণ মানুষকে দিশেহারা করছে তাই নয়, বারোটা বাজাচ্ছে দেশের অর্থনীতিরও। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, এই চক্রকে লালন করছে পুলিশ, শুল্ক বিভাগ আর ব্যাংকের কিছু অসৎ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, দেশে মোট জাল নোটের পরিমাণ হবে আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি জাল নোট যদি প্রতিদিন বাজারে গড়ে পাঁচবার হাতবদল হয় সেই ক্ষেত্রে প্রতিদিন আবর্তনশীল জাল টাকার পরিমাণ হবে পাঁচ হাজার কোটি।
সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল ও মুগদা থেকে ডিবি পুলিশ এক কোটি টাকার জাল নোটসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তারা হচ্ছে সেলিম, আবিদ, জালাল, রোজিনা, শহীদুল ও মরিয়ম। তাদের দলনেতা সেলিম। তাকে মুগদাপাড়া থেকে গ্রেপ্তারের সময় উদ্ধার হয় ল্যাপটপ, প্রিন্টারসহ জাল টাকা তৈরির সরঞ্জাম। পৃথক আরেক অভিযানে পুলিশ ঢাকার পোস্তগোলা থেকে ৫০ লাখ টাকার জাল নোটসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হচ্ছে দলনেতা বাবু আর তার সহযোগী মিয়াজ, ইমন, জিতু, জহির, তমা ও শাহনাজ। এই চক্রের কাছ থেকেও জাল টাকা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। এর আগে আরো কয়েকটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু থামে না এই অপতৎপরতা।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, টাকা জাল করার বড় বড় ঘাঁটি দেশের সীমান্ত এলাকার আশপাশের শহরগুলোতে। জাল নোট বেশি ব্যবহার হয় চোরাই পণ্য কেনাবেচা আর ঘুষ লেনদেনে। কারণ এসব সাধারণত গোপনে ও অন্ধকারে হয়। টাকা গুনে দেখে নেওয়ার মতো সময়ও তাদের হাতে থাকে না।
পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বেশি জাল হচ্ছে ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট। ১০০০ টাকার নোটও জাল হচ্ছে, তবে তা কম। কারণ ১০০০ টাকার নোট নেওয়ার সময় গ্রহীতা বেশি সতর্ক থাকায় ধরা পড়ার আশঙ্কা বেশি।
জাল নোট কারবারিরা নিজেরা নিজেদের কাছে 'জালবাজ' নামে পরিচিত। এই জালবাজরা নকল নোটের মজার মজার নামও রাখে। চক্রভেদে ১০০০ টাকার নোট লারে লাপ্পা, শাহরুখ, জুব্বা; ৫০০ টাকার নোট সালমান, ছক্কাপাঞ্জা, পাঞ্জাবি আর ১০০ টাকার জাল নোট কারিশমা, আলী বাবা ও ধোপা নামে পরিচিত। সাধারণত ঈদ আর পূজা সামনে রেখে এই চক্র জোরালোভাবে মাঠে নামে। আর শীতের সময় মাদক বেচাকেনার সঙ্গে জাল নোটের কারবারও বাড়ে। বিশেষ করে শহর এলাকাগুলোতে রাতেই জালবাজরা বেশি মাঠে নামে।
জালবাজরা সদস্যদের কাছে বিক্রি করে ১০০ টাকার জাল নোট ৪০ টাকায়, ৫০০ টাকার জাল নোট ২০০ টাকায় এবং এক হাজার টাকার জাল নোট ৩০০ টাকায়। তবে ইদানীং বেশি চাহিদা দেখা দিয়েছে ৫০ ও ২০ টাকার নোটের। ৫০ বা ২০ টাকার নোট নেওয়ার সময় কেউই সচরাচর পরখ করে না। তাই এতে ঝুঁকি নেই বললেই চলে।
জালবাজরা ৫০০ ও এর নিচের মূল্যমানের জাল নোট বাজারজাত কাজে সাধারণত দরিদ্র ও অশিক্ষিত লোকদের বেশি বেছে নেয়। এরা দূরের এলাকায় কাজে নামে। একসঙ্গে দু-তিনটির বেশি নোট কাছে রাখে না। এরা সব সময় ক্রেতা সেজেই এই জাল নোট ব্যবহার করে থাকে। আর টার্গেট হিসেবে খুঁজে বের করে অশিক্ষিত আর গোবেচারা ধরনের লোকদের। তাদের লাভের হিসাবটা এ রকম- কোনো একজন সদস্য ২০০ টাকা দিয়ে ৫০০ টাকার একটি জাল নোট কিনে গুলিস্তান গিয়ে ৪০০ টাকার আপেল কিনল। এরপর সে এই আপেল অন্যত্র বিক্রি করল ৩০০ টাকায়। এভাবে তার লাভ হলো ২০০ টাকা। আর আপেলের মতো কমে বিক্রি করা না লাগলে লাভ আরো বেড়ে যায়। এই ফাঁকে নিজের সংসারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও করে। গুলিস্তানে কেনাকাটা শেষ করে বাসে চেপে সে চলে যায় যাত্রাবাড়ী। সেখানকার কাজ সেরে মিরপুর, মিরপুর থেকে উত্তরা। এভাবেই দিনভর জাল টাকা বাজারজাত করে একজন সদস্য। আর ভরা মৌসুমে শপিং সেন্টারগুলোই এদের মূল টার্গেট। তবে ফুটপাতের দোকানপাটকেই তারা বেশি বেছে নেয়।
পুলিশ, গোয়েন্দা ও র‌্যাবের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, জাল টাকার কারবারে জড়িত আছে জঙ্গি, চরমপন্থী আর একাধিক বিদেশি চক্র। বিশেষ করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ এই চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জঙ্গি ও চরমপন্থীরা অস্ত্র-গোলাবারুদ কেনার ক্ষেত্রে জাল টাকা ব্যবহার করে থাকে। সম্প্রতি ডিবি পুলিশ রাজধানীর বনশ্রী এলাকা থেকে সোলায়মান মজুমদার নামে এক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে তার কাছ থেকে অনেক তথ্য পায়। পুলিশ তার কাছ থেকে ভারতীয় ৫৩ হাজার ৫০০ জাল রুপি উদ্ধার করে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, সোলায়মান মজুমদার নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির প্রধান মাওলানা সাইদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এ ছাড়া গত বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা জালিয়াত চক্রের সদস্য দুই তরুণী রীনা ও রুবিনাকে গ্রেপ্তার করা হলে এ-সংক্রান্ত অনেক তথ্য বেরিয়ে আসে। গোয়েন্দাদের মতে, বিদেশি চক্রের মাধ্যমে বছরে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার জাল মুদ্রা দেশে ঢুকছে।
ডিবির উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সোলায়মান মজুমদার পাকিস্তানকেন্দ্রিক জাল মুদ্রা পাচার ও তৈরি চক্রেরও অন্যতম সদস্য। এ ছাড়া দেশে আরো ৯টি আন্তর্জাতিক চক্র জাল মুদ্রার ব্যবসা চক্র আছে। ডিবি এর আগে রফিকুলচক্রসহ আরো চারটি চক্রকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করেছে।
জাল নোট বাজারে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্যাশ কাউন্টার থেকে সরবরাহকৃত টাকার বান্ডিলে এবং এটিএম বুথ থেকে বেরিয়ে আসা জাল নোট শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি জাল নোটের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বৈঠকে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় জালবাজদের গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে টাকা তৈরির আসল কাগজের উৎস সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটন বিশেষ দরকার বলে বৈঠকে আলোচকরা উল্লেখ করেন। প্রয়োজনে জালবাজদের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের অনেক সমস্যা আছে। তাঁরা শুধু জাল টাকা শনাক্ত করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। ব্যাংকের একটি সিন্ডিকেট বা চক্রও এসব জাল টাকা বাজারজাত কাজে জড়িত। অথচ আইনের দুর্বলতার কারণে এই সিন্ডিকেটের কাউকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুমার বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে জাল নোট ছেয়ে যায়। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। জাল নোট প্রতিরোধে পুলিশের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। ব্যাংকের সব শাখায় জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন রাখা বাধ্যতামূলক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আসল নোট চেনার জন্য মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ বলেন, এই জালবাজ চক্রকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ ও র‌্যাবকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঈদ সামনে রেখে তাদের তৎপরতা বেড়েছে। তবে পুলিশ এর চেয়ে বেশি তৎপর বলে তারা ধরাও পড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.