গুড জব, বেটার ইনকাম by মোঃ রোমান দেওয়ান

কাজ করতে আপত্তি নেই যদি কাজের ক্ষেত্র পাওয়া যায়। একটু জীবিকার সন্ধানে দেশের বিশাল বেকারগোষ্ঠী পাগলপ্রায়। ইউরোপ-আমেরিকার দেশেও একই চিত্র। বেকারত্বের চপেটাঘাতে অস্থির যুব সমাজের একাংশ। সবাই যে শুধু হন্যে হয়ে চাকরিই খুঁজছেন তা নয়, কেউ কেউ কিছু ক্যাপিটাল ইনভেস্টও করতে চাচ্ছেন।


কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য প্লেসের অভাবে ইনভেস্ট করতেও সাহস পাচ্ছেন না অনেকেই। এদেশের শেয়ারবাজার একটা সময় কিছুটা স্বস্তি দিলেও এর স্থায়িত্বকাল খুব বেশিদিন ছিল না তা একবাক্যে সবাই স্বীকারও করবেন। তাই হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন বেকাররা এবং শিক্ষিত নিম্ন আয়ের মানুষ। কিন্তু এভাবে বেকারত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে বসে না থেকে ইন্টারনেট দুনিয়ায় পা ফেলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে সহজেই স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে থাকতে হবে একটি পার্সোনাল কম্পিউটার সঙ্গে ইন্টারনেট কানেকশন এবং কাজ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। তবে আশপাশের বা পরিচিতজনদের মধ্যে কেউ আউটসোর্সিংয়ে জড়িত থাকলে তার কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় ধারণাটুকু নেয়া যেতে পারে। এখন জানা দরকার আউটসোর্সিং বলতে কি বোঝানো হয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে আউটসোর্সিং হচ্ছে কোন কোম্পানি বা ব্যক্তির সঙ্গে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে অন্য কোন ব্যক্তি বা কোম্পানির নির্দিষ্ট কর্মসম্পাদনের চুক্তি। পৃথিবীতে ব্যবসায় শুরুর প্রথমদিন থেকেই এ রকম ধারণা ছিল এবং এর তৎপরতাও ভালই ছিল। তখন এই কাজ সাধারণভাবে এবং সাধারণ মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কিন্তু এখনকার আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যম বলতে ইন্টারনেটভিত্তিক কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে অর্থ উর্পাজন করাকে বোঝায়। এবার আসা যাক কারা এবং কেন এর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে কর্ম প্রদানকারী ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, কর্ম সম্পাদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাদেরকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সার এং অন্য পক্ষটি হচ্ছে মধ্যস্থতাকারী বা মাধ্যম। বিশ্বে প্রচুর ব্যক্তি এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিং সেবার সঙ্গে যুক্ত।
কর্মপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এর সঙ্গে জড়িত থাকে মূলত বিভিন্ন অসুবিধা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবলের অভাব থাকলে এই আউটর্সোসিং বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে খুব কম খরচে সহজলভ্য ফ্রিল্যান্সারদের দিয়ে মানসম্মত কাজ করিয়ে নেয়া যায়। জটিল কাজগুলো করার জন্য এ মাধ্যমে দক্ষ লোকের ঘাটতি নেই যার ফলে কর্মপ্রদানকারী কোম্পানিগুলো অতি সহজেই অনেক জটিল কাজ করিয়ে নিতে পারে। দক্ষ ফ্রিল্যান্সাররা তাদের কাজগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে করার জন্য খুবই তৎপর থাকে। প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সররা উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় পদ্ধতিগুলো আরও শক্তিশালী করে দেয়। অভিজ্ঞদের সঙ্গে ব্যবসায়িক ঝুঁকিগুলো বিচার- বিশ্লেষণ করে এগুলো থেকে প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার উপায়ও বের করা যায়। প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত খরচ কমাতে আউটসোর্সিংয়ের ভূমিকা অনেক। কিন্তু সেই সঙ্গে কিছু ক্ষতিকর বা অসুবিধার দিকও থেকে যাচ্ছে যেমন গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য তৃতীয় পক্ষের জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ানুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ সম্পাদন হয় না, সেক্ষেত্রেও ভুক্তভোগীকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অদক্ষ লোকদের দিয়ে কাজ করালে কাজের গুণগত মান বজায় থাকে না। মাঝে মধ্যে হিডেন কস্টের (লুক্কায়িত খরচ) জন্য কোম্পানিগুলোর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়।
অন্যদিকে, ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। অনেক ছাত্রছাত্রী আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তাদের পড়ালেখার খরচ মেটাতে পারছে। অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িত অনেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু ঢুঁ মেরেই টু পাইস কামিয়ে নিচ্ছেন। বেকারদেরও তাই ঝাঁপিয়ে পড়ার ভাল জায়গা হচ্ছে আউটসোর্সিং। এক্ষেত্রে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। কাজ করার স্বাধীনতা থাকে। দৈনিক তিন-চার ঘণ্টা কাজ করে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করা যায়। তবে কাজের মাত্রাটা বাড়ালে ৪০-৫০ হাজার টাকা মাসে আয় করা সম্ভব। ঘরে বসে আয় করা যায় বলে এটা খুবই জনপ্রিয়। সর্বোপরি বেকারত্ব ঘোচাতে এবং অতিরিক্ত আয় করার এটি একটি অভিনব উপায়। আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য অনেক সাইটের মধ্যে গুরু হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্স সাইট। ৫,২০,০০০ এর অধিক ফ্রিল্যান্সার এবং ৩০,০০০ এরও অধিক প্রতিষ্ঠান এতে যুক্ত রয়েছে। তাছাড়া ইল্যান্স ডট কম,রেন্টাকোডার ডট কম, অল ফ্রিল্যান্স ডট কম, প্রোগ্রামিং বিডস ডট কম ইত্যাদি সাইটও খুব জনপ্রিয়। বাংলাদেশে ওডেক্সের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্নমুখী কাজ সম্পাদন করা হয়। সাধারণত যেই কাজগুলো আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত তা হলোÑআইটি আউটসোর্সিং, লিগ্যাল আউটসোর্সিং,কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডিজাইন,রিক্রুটমেন্ট , মেন্যুফেকচারিং, টেকনিক্যাল/কাস্টমার সাপোর্ট। এছাড়া ডাটা এন্ট্রির কাজ ছাড়াও অন্যান্য কাজ এর মাধ্যেমে সম্পাদন করা হয়।
আউটসোর্সিং দুনিয়ার নেতৃত্বে রয়েছে চীন ও ভারত। ২০০৯ সাল থেকে এদেশের ফ্রিল্যান্সররাও অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে যদিও ২০০৩ সাল থেকেই এর প্রচলন শুরু হয়েছিল। জিডিপির বৃদ্ধিতে এই আউটর্সোসিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতে, আউটসোর্সিং এবং ই-কমার্সের প্রসার এবং উন্নতির মাধ্যমে বাংলাদেশে জাতীয় জিডিপি বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলা সম্ভব।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গেও প্রতারক চক্র জড়িত। তাই ফ্রিল্যান্সারদের এবং আগ্রহীদের অবশ্যই কিছু বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। ক্লিক করলেই টাকা, ৭,০০০ টাকা দিয়ে খুলতে হবে এ্যাকাউন্ট। বাড়তি কাউকে ভর্তি করালে প্রতিজনের জন্য দেয়া হবে এক ডলার করে। এটা অনেকটা এমএলএমের মতো। ডিজিটাল প্রতারণা। এই ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আউটসোর্সিংয়ের গাল ভরা বুলি আওড়িয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে ইতোমধ্যেই লাপাত্তা হয়েছে। তাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী। প্রতারণা থেকে বাঁচতে এবং কাজের ব্যাপারে দক্ষতা অর্জনের জন্য অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ঢাকার মগবাজার, ফার্মগেট, ধানম-িসহ অনেক জেলা শহরেও এসব প্রশিক্ষণ প্রদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য খরচ পড়বে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা। তবে একটু খোঁজ নিয়ে তিন-চার হাজার টাকার মধ্যেও দুই-তিন মাসের প্রয়োজনীয় কোর্সটি সম্পন্ন করে কাজে লেগে গেলেই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
আমাদের সকলের প্রচেষ্টা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাই পারে আউটসোর্সিংকে ভাল অবস্থানে নিয়ে যেতে। প্রবাসীদের মতো দেশে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার অন্যতম মাধ্যম হিসেবেও একে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এদেশে জনবলের অভাব নেই। কিন্তু এই জনবলের মধ্যে বেকারদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আউটসোর্সিংয়ে নিযুক্ত করা গেলে তারা একদিকে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পারবে আবার আমাদের দেশকে বেকারত্বের গ্লানি থেকেও মুক্তি দিতে পারবে। এদের দক্ষ করে তুলে কাজে লাগালে আইটি সেক্টরে ভারত-চীনের মতো এদেশের বেকার জনগোষ্ঠীও সামষ্টিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

No comments

Powered by Blogger.