ঢাকা ছাড়ছে ৭০ লাখ- পদে পদে দুর্ভোগ বিড়ম্বনা by রাজন ভট্টাচার্য

ঈদে নাড়ির টানে রাজধানী ছাড়ছে ৭০ লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে লঞ্চযোগে ৪০ লাখের বেশি যাত্রী যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। নৌ-পথে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাড়ি ফিরলেও বিড়ম্বনার শেষ নেই। তিন-চারগুণ যাত্রীসহ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে শেকড়ের টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ।
একটি লঞ্চেও নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম। ছাদ-ডেক থেকে শুরু করে ঠাঁই নেই লঞ্চের কোথাও। অবশ্য বাসটার্মিনালগুলোতে তেমন একটা ভিড় ছিল না। তবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, মাওয়া ফেরিঘাট, ঢাকা-চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ছিল তীব্র যানজট। এর মধ্যে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয় চট্টগ্রাম মহাসড়কে। সময়মতো ড্রেজিং না করায় মাওয়া ফেরিঘাটে পারাপারের সময় মাঝনদীতে আটকে যাচ্ছিল ফেরি। সব মিলেয়ে কোথাও বাস-ট্রেন-লঞ্চের সিডিউল ঠিক নেই।
ট্রেনে সিডিউল বিপর্যয় চলছেই ॥ কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে নির্ধারিত সময়ে ট্রেন ছেড়ে যেতে পারেনি। এ কারণে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে সারদায় ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে রাজশাহীর সঙ্গে দুপুর পর্যন্ত ঢাকার রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল। রাজশাহী ছাড়া অন্যান্য রুটেও এক থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হয়। এদিকে স্টেশন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে টিকেট কালোবাজারির অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। তারা বলছেন, অগ্রিম টিকেট বিক্রির সময় কাউন্টার থেকে বলা হয়েছিল টিকেট শেষ। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগে সিটসহ টিকেট বিক্রি করতে দেখা গেছে। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়, অপেক্ষার নির্ঘুম রাত, চরম ভোগান্তি সব কিছুকে মাড়িয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল নামে সকাল থেকেই। কিন্তু কখন তারা গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন সে প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না বৃহস্পতিবার ।
সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় বাড়ছে। চোখেমুখে তাদের উৎকণ্ঠা, কখন ট্রেন আসবে। ট্রেন আসা মাত্রই ছাদ, দুই ট্রেনের জোড়া, ক্যান্টিনসহ সব খানেই জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা চলছিল। রেলস্টেশনের ম্যানেজার খায়রুল বাশার ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে জানান, রাজশাহীতে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়া ও অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানামার কারণে কিছু ট্রেনের আসা-যাওয়ায় বিলম্ব হচ্ছে। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি সকাল ৯টার আগে স্টেশনেই আসেনি। রাজশাহীগামী ধুমকেতু সকাল ৬টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি কমলাপুর আসে ৯টার পর। বৃহস্পতিবার সকালে টিকেট কালোবাজারির সময় হুমায়ুন নামে কমলাপুর রেলস্টেশনের এক কর্মচারীকে আটক করেছে আর্মড পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বিভিন্ন ট্রেনের ১২ টিকেট পাওয়া যায়। ঈদ উপলক্ষে খুলনা-ঢাকা-খুলনা রুটে বুধবার রাত ১০টা থেকে বাড়তি দুটি ট্রেন চালু করা হয়েছে। এ ট্রেনের নাম দেয়া হয়েছে ঈদ স্পেশাল ট্রেন-৩ ও ৪।

ভোগান্তি কমেনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে
ভোগান্তি কমেনি ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে। বুধবারের মতো বৃহস্পতিবারও এই রুটের বিভিন্ন অংশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে ঘরমুখো মানুষ। প্রায় ৮০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয় গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায়। তবে একটানা যানজট ছিল না। কিছুদূর পরপর রাস্তা ফাঁকা দেখা গেছে। আবার কিছুদূর পর স্থানীয় বাজার বা লোকালয়ের পাশের মহাসড়কে যানজট দেখা দেয়।
পরিবহন মালিকসহ চালকরা জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অল্প গতির যানবাহন চলাচল, ছোট যানবাহনগুলো যেমন খুশি রাস্তা ব্যবহারসহ ওভারটেক করতে গিয়েই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি লোকাল বাস, কাভার্ডভ্যান-লরি থামিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি তো আছেই। কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুর থেকে শুরু করে ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনা থেকে বুড়িচংয়ের কালাকচুয়া ও ক্যান্টনমেন্ট থেকে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী থেকে চৌদ্দগ্রামের মিয়ার বাজার এলাকায় সকাল থেকে যানজটের কারণে খুব ধীরগতিতে গাড়ি চলাচল করছে। এছাড়া পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, মাওয়া ফেরিঘাটে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ছিল দীর্ঘ যানজট। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মহাসড়কে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রেকার না রাখা, অবৈধ দোকানপাট, বাজারসহ টার্মিনাল উচ্ছেদ না করা, লক্কড়ঝক্কড় যানবাহনসহ নসিমন, করিমন ও ভটভটির দৌরাত্ম্য তো আছেই।

তিল ধারণের ঠাঁই নেই লঞ্চে
তিল ধরার ঠাঁই নেই ঢাকার সদরঘাট থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে। যাত্রী নিরাপত্তার বালাই নেই। নিরাপত্তার কথা না ভেবে একটু জায়গা পাওয়াই যেন সবচেয়ে বড় প্রশান্তির বিষয় ছিল যাত্রীদের কাছে। ১৪-১৯ আগস্ট পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৪৫ রুটে ৪০ লাখের বেশি যাত্রী পরিবহনের টার্গেট লঞ্চ মালিক সমিতির। সদরঘাট থেকে দিনে দেড় শতাধিক লঞ্চ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে।
বৃহস্পতিবার সদরঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, টিকেট না পেয়ে লঞ্চের ছাদে চড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের হাজারও মানুষ। লঞ্চের ছাদে চড়তে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেউ মানছে না সেই নির্দেশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও কোন বাধা নেই। তিন থেকে চারগুণ নিয়ে টার্মিনাল ছাড়ছে লঞ্চ। লঞ্চ মালিকরা দাবি করছেন, দক্ষিণাঞ্চলের ৩০ লাখ লঞ্চযাত্রী রয়েছে। ক্যাবিন, ডেক ও সোফা মিলিয়ে লঞ্চে এত যাত্রী বহনের কোনো সুযোগ নেই। ফলে বাধ্য হয়েই যাত্রীরা লঞ্চের ছাদে চড়ছে। কর্তৃপক্ষের মানা তারা শুনছে না। বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা ছাড়াও এসব জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঢাকা থেকে সরাসরি লঞ্চ চালু রয়েছে। এসব লঞ্চে ক্যাবিন প্রত্যাশী যাত্রীর সংখ্যা ২৫ হাজারেরও বেশি। তার বিপরীতে ক্যাবিন রয়েছে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোর মধ্যে বিলাসবহুল লঞ্চ মাত্র ১১। বিলাসবহুল ১১ লঞ্চ মিলিয়ে সবক’টিতে ক্যাবিন রয়েছে মাত্র ৯৩০টি। লঞ্চের টিকেট কালোবাজারি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সদরঘাট টার্মিনালে আসা যাত্রীদের অনেকেই। তারা বলেন, ‘কাউন্টারে টিকেট নেই। সব টিকেট দালালদের কাছে। কয়েকগুণ বেশি দাম দিলেই টিকেট মিলছে।

বাসটার্মিনালে যাত্রী কম
মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাসটার্মিনালে বৃহস্পতিবার দিনভর যাত্রী চাপ কম ছিল। পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন, মঙ্গল ও বুধবার যাত্রী চাপ বেশি ছিল। দীর্ঘ সময় ছুটি থাকার কারণে বৃহস্পতিবার থেকে চাপ কমেছে। তবে শুক্রবার অফিস শেষে গার্মেন্টস ছুটির পর আবারো সরগরম হবে বাস টার্মিনালগুলো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ জনকণ্ঠ’কে জানান, রাজধানীর সবকটি বাসটার্মিনালে তুলনামূলক যাত্রী কম। বিলাসবহুল বাসগুলো অনেক সময় সিট খালি রেখেই বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম মোল্লা জনকণ্ঠ’কে জানান, টার্মিনালের ভেতরে বাইরে থেকে দিনে আড়াই হাজার বাস ছেড়ে যাচ্ছে। গত দুই দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার যাত্রী কম থাকার কথাও জানান তিনি।

৭০ লাখের বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়ছে
ঈদ উপলক্ষে ৭০ লাখের বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। এই হিসেবে নগরীতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ডিসি (ডিবি) ও ডিএমপি মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম জানান, ঈদে ৬০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। তাই বাসাবাড়ির নিরাপত্তা দিতে নেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এদিকে নগরীর সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন প্র্য়া আড়াই হাজার বাস বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। মহাখালী থেকে দেড় হাজার ও গাবতলী থেকে দেড় হাজারের বেশি বাস ছাড়ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার বাস চলাচল করছে বিভিন্ন রুটে। বাসপ্রতি ৪০ যাত্রী পরিবহন করা হলে দিনে প্রায় আড়াই লাখ যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। ছাদসহ দাঁড় করিয়েও লোক নেয়া হচ্ছে। এই হিসেবে তিন লাখের বেশি। ১৩-১৯ আগস্ট পর্যন্ত বাসে ২১ লাখ যাত্রী পরিবহন সম্ভব। এছাড়াও প্রাইভেট কারসহ নিজস্ব ব্যবস্থায় যাচ্ছে পাঁচ লাখ মানুষ। ১৪-১৯ আগস্ট পর্যন্ত ৪০ লাখ যাত্রী পরিবহনের টার্গেট লঞ্চ মালিকদের। ১৪-১৯ তারিখ পর্যন্ত ছয় দিনে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ট্রেনযোগে ঢাকা ছাড়বে। আকাশপথে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যাও কম নয়। সব মিলিয়ে ৭০ লাখের বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়ছে এবারের ঈদে। রাজধানীর মোট জনসংখ্যার সোয়া কোটিরও বেশি। এই হিসেবে তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.