সিডিউলড রুট বন্ধ করে হজ ফ্লাইট ॥ সঙ্কটে বিমান- ০ বার বার দরপত্র আহ্বান করেও হজ ফ্লাইটের জন্য লিজে উড়োজাহাজ মেলেনি -০ এক মাসের মধ্যে বন্ধ হচ্ছে হংকং ব্যাঙ্কক দিল্লী ও করাচী রুট- ০ ফ্লাইট কমাতে হবে লন্ডন সিঙ্গাপুর রোম রুটে- ০ দেখা দেবে ভয়াবহ সিডিউল বিপর্যয় by আজাদ সুলায়মান

বার বার দরপত্র ডেকেও হজ ফ্লাইট লিজ নিতে পারেনি। অথচ হজের প্রথম ফ্লাইট শুরু হচ্ছে মাত্র তিন সপ্তাহ পর। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে এখন সিডিউলড ফ্লাইট লাগানো হবে হজে। এতে বন্ধ করতে হচ্ছে চল্লিশ বছরের প্রতিষ্ঠিত রুট। বিমান বলছে, উড়োজাহাজ নেই। হজ তো করাতে হবে।


বিমান কেন প্রয়োজনীয় উড়োজাহাজ সঠিক সময়ে লিজে নিতে পারেনি সে রহস্য ক্রমেই দানা বাঁধছে। অভিযোগ উঠেছে- কমিশনের ভাগাভাগি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় কৃত্রিম সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বিমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় চতুর্মুখী সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে বিমান। এ জন্য দায়ী বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের গুটিকয়েক সদস্য। যারা নিজেদের সম্রাট আকবরের চেয়েও পণ্ডিত আর খলিফা ওমরের মতো সৎ দাবি করেন। নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান পর্ষদ একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে অটল। বিমান ধ্বংসের এতো নিপুণ আয়োজন অতীতে আর কখনও লক্ষ্য করা যায়নি। লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে একের পর এক বন্ধ করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ রুট। আগামী মাসে বন্ধ করা হচ্ছে এক সময়ের লাভজনক রুট হংকং, ব্যাংকক, দিল্লী ও করাচী। অথচ গত তিন বছরে একবারও উদ্যোগ নেয়া হয়নি লোকসানের কারণ খুঁজে বের করার। লাভজনক করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। হঠকারী সিদ্ধান্তের এখানেই শেষ নয়। হজ ফ্লাইট রক্ষার অজুহাতে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে লন্ডন, সিঙ্গাপুর ও ইতালির মতো মর্যাদাবান রুটগুলোও। যার পরিণাম হবে আত্মহত্যার শামিল। বিমানের মতো রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত ঠেলে দেয়া হচ্ছে জটিল অন্ধকারে। বিমান বাঁচাও আন্দোলনকারীরা এতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা বলছেন, এছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। বিমানমন্ত্রী ও সচিবও বলছেন, একই কথা বিমান বাঁচাতে হলে লোকসানি রুট বন্ধ করতে হবে। আগে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে, পরে ভিটামিন দিতে হবে।
বিমান পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে দুটি ৭৭৭ ও একটি ডিসি-১০ সিডিউল রুট থেকে প্রত্যাহার করে হজযাত্রী বহন করবে। এতে নিশ্চিত সিডিউলে বিপর্যয় দেখা দেবে। এ বিপর্যয় ঠেকানোর কথা চিন্তা করে মধ্যম সারির একটি উড়োজাহাজ এক বছরের জন্য লিজ নেয়ার দরপত্রও ডাকা হয়েছে। চলতি মাসেই বিষয়টি চূড়ান্ত করারও জোর পাঁয়তারা চলছে।
এ সম্পর্কে এক পরিচালক জানান, পর্ষদের এ চিন্তা কতটা উদ্ভাট তা আগামী মাসেই হাড়ে হাড়ে টের পাবে বিমান। বিমানের পেশাদার ও দীর্ঘ দুই দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ পরিচালক জানান, সিডিউল রুটের তিনটি উড়োজাহাজ প্রত্যাহার করে হজযাত্রী টানার কাজে লাগানোর পরিণাম কিছুতেই ভাল হবে না। এতে ভয়াবহ সিডিউল বিপর্যয় ঘটবে। কিছুতেই সে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। এমন সঙ্কট যে নিশ্চিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এতে বিমানকে অন্তত ৪/৫টি রুট বন্ধ করতে হবে। এগুলো হচ্ছে করাচি, হংকং, ব্যাংকক ও দিল্লী। ফ্লাইট কমাতে হবে অন্তত তিনটি রুটে। ঢাকা-লন্ডন, ঢাকা-সিঙ্গাপুর ও ঢাকা-রোম। এসব রুটের যাত্রীদের কিভাবে মোকাবিলা করা হবে সে ধরনের কোন পরিকল্পনাও বিমান নেয়নি। পর্ষদ গায়ের জোরে এ ধরনের উদ্ভট ও অবাস্তব সিদ্ধান্ত নেয়ায় ব্যবস্থাপনা বিভাগ অসহায়। এ ব্যাপারে বিমান কর্মীদের অভিযোগ- পর্ষদ হজ ফ্লাইট লিজ নিতে র্ব্যথ হয়ে, এখন সিডিউলেরও বিপর্যয় ঘটানোর আয়োজন করেছে। বিমানের বর্তমান পর্ষদ পরপর তিনবার দরপত্র ডেকেও হজের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি উড়োজাহাজ লিজে নিতে পারেনি। বিমানের চল্লিশ বছরের প্রতিষ্ঠিত এ সব রুট ধ্বংস করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জনৈক পর্ষদ সদস্যের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, সিডিউল রুট থেকে দুটি ৭৭৭ ও একটি ডিসি-১০ প্রত্যাহার করলেই কেন ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। প্রয়োজনে একটি উড়োজাহাজ এক বছরের জন্য লিজে নিয়ে সিডিউল ফ্লাইট সামাল দেয়া হবে।
তার এ যুুুক্তিকে খোঁড়া উল্লেখ করে, মার্কেটিং শাখার এক কর্মকতা বলেন, উড়োজাহাজ লিজে নেয়াটা কি মুড়ির ব্যবসা যে, ইচ্ছে করলেই টাকা নিয়ে সকালে বাজারে গিয়ে বিকেলে ব্যাগ ভরে নিয়ে আসা যাবে। যেখানে গত মে মাস থেকে শুরু করে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত পর পর তিন দফা দরপত্র ডেকেও প্রয়োজনীয় উড়োজাহাজ নিতে পারেনি। সেখানে শেষ মুহূর্তে এসে কেন এত তাড়াহুড়ো করে ফের দরপত্র ডাকা হয়েছে। এটাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আগামী এক মাসের মধ্যেই কি একটা উড়োজাহাজ লিজে নিয়ে বহরে যুক্ত করা সম্ভব? তেমন সম্ভাবনা একেবারেই নেই। বিমানের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এক মাসের মধ্যে উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার নজির বা অভিজ্ঞতা নেই। ফলে বিপর্যয় অনিবার্য। কেননা উল্লেখিত রুট হজের তিনমাস বন্ধ রাখা ও কাটছাঁট করার মানেই হলো বিপর্যয় ডেকে আনা। একবার রুট বন্ধ করা বা বিচ্ছিন্ন করা হলে সেটা পুনরুদ্ধার হবে দুঃসাধ্য। এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, হঠাৎ রুট বন্ধ করার পরিণাম হবে চরম আত্মঘাতী। এতে শুধু রুটেরই ক্ষতি হবে না। দেখা দেবে চরম বিশৃঙ্খলা। অগ্রিম টিকেট বিক্রি করা যাত্রীদের সামাল দেয়াটাই হবে বিমানের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। তেমনি হজ মৌসুম শেষে আবার যখন ফিরিয়ে আনা হবে, তখন সহজে আর যাত্রী মিলবে না। যারা একবার বিমান ত্যাগ করবে তারা আর ফিরবে না।
এ ব্যাপারে মার্কেটিং শাখা থেকে জানা যায়, ঢাকা-লন্ডন ও ঢাকা-রোম রুটের আগামী তিন মাসের টিকেট ইতোমধ্যে অগ্রিম বিক্রি করা হয়ে গেছে। এখন এসব যাত্রীকে সঠিকভাবে লন্ডন পাঠাতে বিমান বাধ্য। বাস্তবতা হচ্ছে এসব যাত্রীকে কিছুতেই পাঠানোর উপায় থাকবে না বিমানের। একই পরিস্থিতি ঘটবে অন্য তিনটি রুটেও।
সঙ্কটের সূত্রপাত যেভাবে
জানা যায়, আগামী মাসের ১৭ তাারিখ থেকে হজ ফ্লাইট শুরু হচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ১ লাখ ১২ হাজার হজযাত্রীর অর্ধেক ৫৬ হাজার বহন করবে। এটা নিশ্চিত হয় মে মাসে। তখন বিমান কমপক্ষে ৩টি উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিমান বোর্ড অনেক সমীক্ষা করেই তিনটি উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যা ছিল খুবই বাস্তবসম্মত। আসলেই এত সংখ্যক যাত্রী বহনে ৩টি উড়োজাহাজ ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। বিমানের সাবেক পরিচালক বলেন, বিমান প্রথমে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। কিন্তুু পর্ষদ সদস্যরা কমিশন বাণিজ্যের লোভে নানামুখী অশুভ পাঁয়তারা চালায়। যে কারণে দুর্নীতিবাজরা লিজে উড়োজাহাজ দেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এতেই দরপত্র নিয়ে শুরুতেই দেখা দেয় নানাবিধ জটিলতা ।
জানা যায়, প্রথম দফা দরপত্রে মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সেগুলো ছিল লায়ন এয়ার, কাবো, এভিকো, আটলান্টা ও নেইমা। সে সময় আটলান্টা সবচেয়ে কম দামে অফার করে মাত্র ৮৫০০ ডলার। বিমান সেটা গ্রহণও করে। কিন্তু আটলান্টা সে দরে উড়োজাহাজ না দিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এতে বিমান বিপাকে পড়ে ফের দরপত্র ডাকে। তখন কাবোও অংশ নেয় এবং কঠিন সব শর্তবলী পূরণ করে টিকে যায়। কিন্তুু তাতেও উড়োজাহাজ নেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর চলে সরাসরি দরকষাকষির চেষ্টা। তাতে আটলান্টা অফার করে প্রতি ঘণ্টায় ১০,০০০ হাজার ডলার। বিমানের কয়েক চতুর কর্মকর্তা আঁচ করতে পারেনÑ এতে দুদকের ঝামেলায় পড়তে হবে। কারণ প্রথম ৮৫০০ ডলারের অফার উপেক্ষা করে এখন যদি ১০ হাজার ডলারে আটলান্টার উড়োজাহাজ নেয়া হয়, তাহলে দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে। এ অবস্থায় তিন সদস্য ফের তাড়াহুড়ো করে দরপত্র ডাকার পরামর্শ দেয়। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। এবারও আটলান্টাসহ কোন কোম্পানিই দরপত্রে উত্তীর্ণই হতে পারেনি। এ অবস্থায় টিকে থাকে সবেধন নীলমণি কাবো। তখনই বিমান পড়ে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায়।
কাবো কেন অপাংক্তেয়?
দরপত্রে টিকে যাওয়ায় কাবো উড়োজাহাজ পজিশন করার প্রস্তুতি নেয়। প্রয়োজনীয় লোকবল পাইলট ও কেবিন ক্রু নিয়োগ চূড়ান্ত করে। হজের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে বিপুল অঙ্কের খরচও করে ফেলে। আর তখনই বিমান পিছু হটে। বিমান বোর্ডের আরেকটি অশুভ সিন্ডিকেট তৎপর হয় আটলান্টার জাহাজ নিতে। কিন্তু দরপত্রের সব শর্ত পূরণ করে কাবো টিকে যাওয়ায় তাকে বাদ দেয়ারও গ্রহণযোগ্য অজুহাত খোঁজে পায়নি। কোন কারণ ছাড়া সরাসরি কাবোর অফার প্রত্যাখ্যান করলে আইনী জটিলতায় পড়তে পারে বিমান। এমন আশঙ্কায় বিমান থেকে মহাব্যবস্থাপক মামদুদ খানকে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে কাবোর উড়োজাহাজ পরিদর্শনে। এমনকি বোয়িং সদর দফতর সিয়াটলে গিয়েও খোঁজখবর নেয়া হয়। সেখান থেকেও কাবোর বিরুদ্ধে কোনরকম অভিযোগ না পাওয়ায় বিমান প্রতিনিধি ঢাকায় ফিরে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতেও কাবোর বিরুদ্ধে কোন ধরনের শর্ত পূরণের বরখেলাপের অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি। এ অবস্থায় কাবোর উড়োজাহাজ লিজে নেয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে বিমান পরিচালনা পর্ষদ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। কেননা এবার কাবোর অফার যতই স্বচ্ছ হোকÑ তার অতীত বদনামে ভরা। ২০০৯ সালের হজে কাবোর উড়োজাহাজ লিজে নিয়ে বিমান বোর্ড কঠোর সমালোচনা ও দুর্নামের শিকার হয়। তখন এ নিয়ে তৎকালীন মন্ত্রী জিএম কাদেরও বিমান পর্ষদের কঠোর সমালোচনা করেন। এ নিয়ে মিডিয়াতেও ঝড় ওঠে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি দুদক পর্যন্ত গড়ায়।
এ ব্যাপারে বিমানের লিজ কমিটির এক সদস্য বলেন, অতীত কেলেঙ্কারি থাকায় এবার বিমান মনস্তাত্ত্বিক কারণে সাহস করছে না কাবোর উড়োজাহাজ নিতে। অবস্থা দাঁড়ায়Ñ একবার চুন খেয়ে মুখ পোড়ায়, এখন দৈ খেতেও ভয়। এ সুযোগে দরপত্রে অংশ নেয়া আটলান্টা তাদের উড়োজাহাজ গছানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু আটলান্টারও অতীত কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত। গত বছর জামানতের প্রায় বাইশ কোটি টাকা ফেরত না দিয়েই আটলান্টার উড়োজাহাজ চুক্তির মেয়াদ শেষে বিমান থেকে প্রত্যাহার করে দেশে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সে টাকা ফেরত পাবার জন্য বিমান অনেক দেনদরবার করেও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বিমান মামলা করে। তার পরও টাকা ফেরত দেবে না বলে জানিয়ে দেয় আটলান্টা। এ রকম আইনী লড়াই চলা অবস্থায় হঠাৎ আটলান্টা এবার হজ লিজে অংশ নেয়ার আশায় কিছু টাকা ফেরত দিতে রাজি হয়। এরপর আটলান্টার পক্ষে বিমানের একটি সিন্ডিকেট জোর তৎপর হয়ে কাবোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। যাতে হজের শেষ মুহূর্তে এয়ার আটলান্টার জাহাজ নেয়া ছাড়া কোন বিকল্প না থাকে।
জানা যায়, শুধু কমিশন ভাগাভাগিতে বনিবনা না হওয়ায় উড়োজাহাজ লিজ নিতে ন্যক্কারজনক ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বিমান। বার বার দরপত্র ডেকে যে ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেÑ তার জন্য এখন চরম খেসারত দেবার উপক্রম হয়েছে। সব শর্ত পূরণ করার পরও কাবোর উড়োজাহাজ না নেয়ার জেদ ধরেছে পর্ষদ। পরিস্থিতি সামাল দিতে একটি মাঝারি মানের উড়োজাহাজ লিজে নিতে বিমান চলতি মাসে সংক্ষিপ্ত সময় দিয়ে দরপত্র আহ্বান করে। এতেও যে শর্ত দেয়া হয়েছেÑ তাতে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠছে একটি বিশেষ কোম্পানির উড়োজাহাজ নেবার জন্যই জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিমানের এক কনসালটেন্টের বিতর্কিত তদবিবাজ লন্ডন গিয়ে বিশ্বাস নামের এক সঙ্গে জোর লবিং চালাচ্ছে।
কার স্বার্থে রুট বন্ধ?
বিমান সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেÑ করাচি, হংকং, ব্যাংকক ও দিল্লী রুট বন্ধ করে দেবার। এ ছাড়া লন্ডন, সিঙ্গাপুুর ও ইতালি রুটের সøট কমিয়ে আনা হবে। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য পর্ষদ বৈঠকে এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের খবরে তোলপাড় চলছে। লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে এসব রুট বন্ধ করা হচ্ছে। বাপার সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন নাসিম এহেন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এসব রুটে কেন লোকসান হচ্ছে সেটার কারণ খোঁজে বের করা উচিত। উড়োজাহাজ ভরে যাত্রী যায়, অথচ লোকসান হচ্ছে-এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। যারা দায়িত্বে তারাই যদি চুরি করে, তাহলে আর উপায় কি?’
এ ব্যাপারে জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতির ভয়াবহ তথ্য। উল্লেখিত রুটের স্টেশনগুলোতে যারা গত তিন বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে লোকসানের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এমন কি হাতেনাতে লুটপাটের ঘটনা ধরা পড়ার পরও বিমান বোর্ডের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তারাই জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নিই। উল্টো পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। উদাহরণ টেনে বললেন, এক পরিচালক, সিঙ্গাপুর রুট এক সময় লাভজনক ছিল। কিন্তু বর্তমান বোর্ডের বিগত সাড়ে তিন বছরে লাভের পাল্লা কমছে। এ জন্য সেখানকার কান্ট্রি ম্যানেজার আরিফকে অভিযুক্ত করা হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং দুর্নীতির টাকা ভাগবাটোয়ার বিনিময়ে তাকে ম্যানেজার থেকে ডিজিএম হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হযেছে। সিবিএ সভাপতি মশিকুর বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সাবেক জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতা আরিফকে তাড়াহুড়ো করে পদোন্নতি দেয়ার ঘটনায় বিমানের সাড়ে চার হাজার কর্মীই বিস্মিত। এতে মনে হচ্ছে বর্তমান পর্ষদ বিএনপি জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করছে। আমরা এ নিয়ে বহু আপত্তি তুলেছি। কিন্তুু কোন কাজ হচ্ছে না।
জানা যায়, আরিফকে পদোন্নতি দেয়ার নেপথ্যেও উৎকোচ আর উপঢৌকন লেনদেন হয়েছে বলে শীর্ষ অনলাইন বাংলানিউজ খবর প্রকাশ করায় তোলপাড় হয়।
আরিফের মতোই লন্ডনের শামছুল করিমকে তিনবছরের স্থলে পাঁচ বছর থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ। আরও আশ্চর্যের বিষয়, লন্ডনের নাগরিকত্ব পাবার জন্য বিমান তার মতো চিহ্নিত লোককে পুরো পাঁচ বছর লালনপালন করে। শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্ব পাবার পরই তাকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় আরেক বিতর্কিত চিশতিকে। যার বিরুদ্ধে রয়েছে দিল্লী স্টেশনে লুটপাটের অভিযোগ।
বিমান বাঁচাও আন্দোলনকারীদের নেতা মশিকুর বলেন, আলোচিত রুটগুলো লোকসানি হবার কোন কারণ নেই। অন্যরা লাভ করেÑ বিমান কেন লোকসানে। আজ পর্যন্ত লোকসানের কারণ বের করার ন্যূনতম উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মার্কেট সমীক্ষা করা হয়নি। অথচ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে লোকসানের অজুহাতে রুট বন্ধ করার। এটা হবে মাথাব্যথায় ওষুধ না দিয়ে মাথা কেটে ফেলে দেয়া। এর জন্য বিমানকে চরম মাশুল দিতে হবে। কেননা একবার রুট বন্ধ হলে তা আর চালু করা যাবে না। নিউইয়র্ক তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এসব রুট তো লেবার রুট নয়। বেশ মর্যাদাবান যাত্রীরাই এসব রুটে চলেন। লোকসানই যদি বন্ধের কারণ হয়, তাহলে লন্ডন কেন রাখা হচ্ছে। লন্ডনে আরও ভয়াবহ লোকসান হচ্ছে। আমি নিশ্চিত এসব স্টেশনের লুটেরাদের প্রত্যাহার করে ন্যায় নিষ্ঠাবান, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলে অবশ্যই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’
এসব সিদ্ধান্ত যে আসলেই হঠকারি তার উদাহরণ টেনে অর্থ বিভাগের এক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, দিল্লী রুট থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে সাড়ে তিন কোটি থেকে চার কোটি টাকা রাজস্ব আসে। সে টাকা থেকে প্রতি মাসে ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করা বাবদ পরিশোধ করতে হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাকি টাকা পাঠানো হয় লন্ডনে। এখন যদি এ রুট বন্ধ করা হয় তাহলে ভারতের আকাশসীমা ব্যবহারের টাকা যোগাতে হবে অন্য খাত থেকে। সে টাকা আসবে কোথা হতে? তাছাড়া দিল্লী থেকে তো কুয়ালালামপুরেরও যাত্রী ওঠে। রুট না থাকলে তো সেটা কুয়ালালামপুরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এসব বিশ্লেষণ বা সমীক্ষা কি করা হয়েছে? আসলে অর্থ বিভাগ থেকে বিমানের লাভ লোকসানের প্রকৃত তথ্য কখনই পর্ষদকে দেয়া হয় না। এখানেও বিমান ধ্বংস করতে একটি শক্তিশালী চক্র ঘাপটি মেরে রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের এমডি ও জনসংযোগ বিভাগের কারওর কাছ থেকেই কোন তথ্য বা বক্তব্য মিলেনি।
জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক খান মোশাররফ হোসেন শনিবার বলেন, ‘লাভলোকসানের প্রকৃত তথ্য অর্থ বিভাগ থেকে কখনই জানতে দেয়া হয় না। কেন জানি ওরা এটা সব সময় গোপন রাখতে চায়। তার পরও আসুন আগামীকাল। চেষ্টা করে দেখি মন্জুর ইমামের কাছ থেকে নেয়া যায় কিনা।’
৭৭৭ ধ্বংসের পাঁয়তারা?
৭৭৭ আনা হয়েছিল ঢাকা-লন্ডন ও নিউইয়র্কের মতো লং রুটে চালানোর জন্য। বিশ্বের অত্যাধুনিক এসব উড়োজাহাজের ইন্টেরিয়র ডেক সেভাবেই সাজানো ও আধুনিকায়ন করা। এর যাত্রীও হতে হবে সে রকম মর্যাদাবান। কিন্তু এ দুটো ৭৭৭ উড়োজাহাজ দিয়ে আগামী তিন মাস যদি হাজী টানা হয়, তাহলে অবস্থা হবে শোচনীয়। জীবনে কোনদিন উড়োজাহাজে ওঠেননি এমন সব হাজী কিভাবে এ উড়োজাহাজের আচরণবিধি মেনে চলবেন।
এ ব্যাপারে এক এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, দুনিয়ার কোন দেশ হজযাত্রী বহনে এত নতুন উড়োজাহাজ ব্যবহার করে না। এতে ইঞ্জিনের সাইক্লিং আওয়ার নষ্ট হয়। বিমান এটা ভাল করে জেনেও কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বোধগম্য নয়। এটা কি সাবোটাজ নাকি অন্যকিছু খতিয়ে দেখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.