আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময় আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়...- আজ চিরবিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুলের প্রয়াণ দিবস by মোরসালিন মিজান

“আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,/আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।/আমি মানব দানব দেবতার ভয়,/বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়...” নিজেকে এভাবেই এঁকেছিলেন তিনি। এই ছিল তাঁর আত্মপরিচয়। ‘অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন অবলীলায়। ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলেছিলেন।


পাঠ্যবইয়ের পাতায় পড়া ‘দুখু মিয়া’ তিনি। তিনি প্রেম, সাম্য আর মানবতার কবি ও কা-ারি কাজী নজরুল ইসলাম। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এ মহান পুরুষের ৩৬তম প্রয়াণ বার্ষিকী আজ ১২ ভাদ্র সোমবার। ১৩৮৩ সালের এই দিনে চির অভিমানী কবির মহাকাব্যিক জীবনের অবসান ঘটে। দীর্ঘদিন চেতনাহীন নির্বাক থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ঢাকায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের বিপুল বিশাল ভা-ারটি তিনি গড়ে দিয়ে গেছেন। বাঙালীর চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতকে নাড়া দিয়েছেন ভীষণভাবে।
অসংখ্য কালজয়ী কবিতার জনক তিনি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি তাঁকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করে। এর মাধ্যমে সকল নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান কবি। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খেলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো দারুণ হৈচৈ ফেলে দেয় সে সময়।
গদ্য রচনার সময়ও স্বতন্ত্র চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল। তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখানেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এই এখানে বসেই তিনি লেখেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’
নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে তাঁর সঙ্গীত। জীবদ্দশায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে আশ্চর্য রকম সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি রাগ এক একটি বিস্ময়।
কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সকল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। নারীর প্রতি উপেক্ষা কখনও মেনে নেননি তিনি। সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষের কাছে টেনে নিয়েছেন। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সারাজীবন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি লিখেছেনÑ ‘গাহি সাম্যের গানÑ/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম ক্রীশ্চান...।’ সবার উপরে মানুষের স্থান দিয়ে অন্য জায়গায় তিনি লেখেনÑ ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্!/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/ সব দেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামেও কলমকে অস্ত্র করেছিলেন নজরুল। তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। এ কারণে অসংখ্যবার জেল খাটতে হয় কবিকে। জেলে বসেই তিনি লেখেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী।’ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেন তিনি। হয়ে ওঠেন আজকের কাজী নজরুল ইসলাম।
তবে জীবনের শুরুটা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তার। কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান নজরুলের পড়ালেখার শুরু হয় মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন নজরুল। বালক বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যোগ দেন লেটো দলে। এই লেটো দলেই তার সাহিত্যচর্চার শুরু হয়। পরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেন। সেই একই নজরুল যৌবনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সৈনিকের বেশে যুদ্ধে লড়েন। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। এভাবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবনের অধিকারী নজরুল সামনের দিকে এগিয়ে যান।
তবে ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন তিনি। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাক্শক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারান।
এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন তিনি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক।
কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান ট্র্যাজেডি হিরো। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
প্রতিবারের মতো আজও মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে গভীর প্রেম আর শ্রদ্ধা ভালবাসায় কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করবে বাঙালী। সকালে কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে কর্মসূচীর সূচনা করা হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কবির মাজারে ফুল দেবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বিএনপিসহ অন্যান্য দলের পক্ষ থেকেও কবির মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমী আজ সোমবার বিকেল ৪টায় একাডেমীর সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। অনুষ্ঠানে ‘নজরুল ইসলাম : একটি আদর্শ জীবনীর খোঁজে’ শীর্ষক একক বক্তৃতা করবেন অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। স্বাগত ভাষণ দেবেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। নজরুল একাডেমী জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। টেলিভিশন, বেতার ও দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও থাকবে বিশেষ আয়োজন।
তবে এর পরও সত্য যে, জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বড় কোন অনুষ্ঠান আয়োজন আজ থাকছে না। নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পরিষদ, নজরুলসঙ্গীত সংস্থা কিংবা ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটি নীরবে পার করবে বলে জানা গেছে। কেন এমনটি? জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। ঈদের পর প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তাঁরা বলছেন, অনেকেই ঈদের ছুটিতে থাকায় তেমন কোন অনুষ্ঠান আয়োজন সম্ভব হবে না। জনপ্রিয় শিল্পী ও সংগঠকরা আবার দিন-রাত ব্যস্ত টিভি অনুষ্ঠানে। এ কারণেও উল্লেখযোগ্য কোন অনুষ্ঠান আয়োজন থাকছে না বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় নজরুলপ্রেমী সাধারণ মানুষ দারুণ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ বিস্ময়ের মধ্য দিয়েই আজ পালিত হবে কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ বার্ষিকী।

No comments

Powered by Blogger.