নাজুক গণপরিবহন ব্যবস্থা-পদক্ষেপ দরকার এখনই

সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট পৃথিবীর ১৪০টি শহরের বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে ঢাকার স্থান হয়েছে সবার নিচে। এমন একটি খবরে স্বাভাবিকভাবেই এ নগরের অধিবাসীরা বেদনাহত হয়েছেন। কিন্তু এ অবস্থার জন্য কাউকে দোষারোপ করার উপায় নেই। সবাই চান অবস্থার পরিবর্তন ঘটুক।


সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগে পরিস্থিতি সহনীয় হোক। কিন্তু শহরের বিদ্যমান বাস্তবতা থেকে রেহাই মেলার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। মঙ্গলবারের সমকালে গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে তা নতুনভাবে নাগরিক মাত্রাকেই হতাশ করবে। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার মান অসহনীয়। সমকালের প্রতিবেদনে স্পষ্ট, শুধু অসহনীয় বললে কম বলা হয়। পৃথিবীতে ঢাকাই হয়তো একমাত্র শহর, যেখানে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় কোনো ট্যাক্সি-ক্যাব সেবা নেই। পৃথিবীর সব দেশে বিমানবন্দরে নেমে একজন যাত্রী ট্যাক্সি-ক্যাব ব্যবহার করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পেঁৗছতে পারেন। কিন্তু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পেঁৗছে নতুন কোনো যাত্রীর পক্ষে নিজ উদ্যোগে গন্তব্যে পেঁৗছানো সম্ভব নয়। ট্যাক্সি সেবা সামান্য যা ছিল তাও বিপর্যস্ত। ট্যাক্সি-ক্যাব সোনার হরিণতুল্য, কালো বা নীল ক্যাবের মান ব্যবহার অযোগ্য। সিএনজি অটোরিকশায় ন্যায্যমূল্যে ভ্রমণের উপায় নেই। বিকল্প ভাঙাচোরা বাস সার্ভিস। দিনের পর দিন বেশি ভাড়া নিয়ে নিম্নমানের সেবা দিয়ে চলেছে বাসগুলো। বসার ব্যবস্থা নেই, ক্ষেত্রবিশেষে দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। নির্দিষ্ট স্থানে বাস দাঁড়াবার ব্যবস্থা নেই। যাত্রীরা দরকারের সময়ে বাস পান না। আর গণপরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো রুটও নেই। দ্রুতগামী যান চলাচলের বদলে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম গুনতে হয় সবাইকে। দ্রুত চলাচলের জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরির উদ্যোগগুলো স্লথ, মেট্রোরেলের মতো বিকল্প গণপরিবহন ব্যবস্থাগুলো আশার আলো দেখছে না সহসা। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দূরে থাক, একেবারে তাৎক্ষণিক নতুন বাস নামানোর উদ্যোগগুলোও সুদূরপরাহত। সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগেই বাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা আপাতত নেই। অভিযোগ আছে, পরিবহন খাত রীতিমতো মুনাফালোভীদের একচেটিয়া আধিপত্যে চলে গেছে। সেবা নয়, যেনতেন প্রকারে মুনাফাই তাদের লক্ষ্য। এই মুনাফার ওপর আবার সম্প্রসারিত চাঁদাবাজদের শক্তিশালী হাত। এ অবস্থা থেকে পরিবহন ব্যবস্থাকে উদ্ধার করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ দরকার। কিন্তু তেমন পদক্ষেপ নেই। দুর্ঘটনা কমাতে দরকার চালকদের প্রশিক্ষণ, সুন্দর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। সেসব নিয়েও আশার বাণী নেই। নীতিনির্ধারকদের আলোচনায় গণপরিবহনের সমস্যা বিশেষ গুরুত্বও পাচ্ছে না। ফলে গণপরিবহন নিয়ে নাগরিক দুর্ভোগ যে অব্যাহত থাকবে তা নিশ্চিত। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, এ যাবৎ গণপরিবহন নয়, প্রাইভেট পরিবহনই কর্তাব্যক্তিদের মনোযোগ পেয়েছে। এর ফলে ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। রাস্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ যথাসময়ে সঠিক পরিকল্পনা নিলে ব্যক্তিগত পরিবহনের সংখ্য সীমিত রেখে গণপরিবহনের দিকে আকৃষ্ট করা যেত নগরবাসীকে। এর জন্য শুধু দরকার সহজলভ্য, সুন্দর ও আরামদায়ক বাস সেবা। প্রার্থিত সেবা পেলে বাড়তি মূল্য দিতে নিশ্চয়ই কারও আপত্তি নেই। কিন্তু সেই সেবা কোথায়? রাস্তায় যাত্রীরা ঠকেই চলেছেন। আমরা মনে করি, এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন দরকার। আর এ জন্য সরকারের আশু মনোযোগ দরকার। শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থার এমন নৈরাজ্য বজায় থাকলে এ শহরকে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো শহর নামেই অভিহিত করা যাবে না আর। সে অবস্থা তৈরি হওয়ার আগেই পদক্ষেপ আসুক, সেটাই প্রত্যাশিত।

No comments

Powered by Blogger.