উফ! রাষ্ট্রপতি ভবন! by ইন্দ্রজিৎ হাজরা

কেউ ঠিক লক্ষ করেনি, কিন্তু উড়িষ্যা সত্যি হতাশই হয়েছে। আবার। একটি সম্ভাবনা জেগেছিল যে শেষ পর্যন্ত তাঁদের একজন ভারতের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। কিন্তু উড়িষ্যার কেউ, কোনো দলের পক্ষেই রাষ্ট্রপতি পদের জন্য যথার্থ যোগ্যতার স্তরে আসেনি। সেই ক্ষত বাড়িয়ে ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হয়েছেন একজন বাঙালি।


উড়িষ্যারই দরজার কাছে বাংলা উৎসবে ফেটে পড়েছে, প্রতিবেশী উড়িষ্যার মানুষদের রাতভর জাগিয়ে রেখেছে।
ষাটের দশকের শেষদিকে ববাহগিরি ভেঙ্কট গিরি (ভিভি গিরি) যখন ভারতের চতুর্থ রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। উড়িষ্যার অনেক মানুষ মনে করেছিল, শেষ পর্যন্ত তাদের একজন রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করলেন। কিন্তু এ সংবাদ বেরিয়ে পড়ে যে ভিভি গিরি পুরনো মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির বহরমপুরের মানুষ। যদিও বহরমপুর এখন উড়িষ্যারই অংশ; কিন্তু ভিভি গিরি ছিলেন তেলেগু ভাষাভাষী পরিবারের সন্তান। সুতরাং জাতিসত্তার হিসেবে তাঁকে উড়িষ্যার মানুষ মনে করাটা ছিল বৃথা। ঠিক যেমন উড়িষ্যার কটকে (তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীন) জন্মগ্রহণ করার কারণে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে বলা হয় 'আমাদের সন্তান'।
অন্যদিকে প্রণব মুখার্জির রাইজিনা পাহাড়ে উঠে আসা- সেই যে প্রণব মুখার্জি একসময় পুনর্জন্ম নিয়ে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন সে রকম নয়, প্রকৃত অর্থেই তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছেন। যা বাঙালিদের মধ্যে নির্ভেজাল গৌরবের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাঙালি, সে কলকাতারই হোক, আর শিল্পনগরী ডেট্রয়েটই হোক অথবা অন্য কোথাও হোক, তাদের কাছে ভারতের যথাযোগ্য অধিনায়ক হিসেবে প্রণব মুখার্জির দক্ষতা বা ক্ষমতা বড় কথা নয়, তাঁর জাতিসত্তাটাই বড় করে প্রকাশ পেয়েছে। জাতিগতভাবে নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে দমিয়ে রাখা হয় বলে যে ধারণা কয়েক যুগ ধরে আছে, তা অবশেষে সমাপ্ত হলো। প্রণবদার রাষ্ট্রপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৩৯ সালে জাতীয় কংগ্রেস থেকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে বহিষ্কার, ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় অথবা ২০০৬ সালে সৌরভ গাঙ্গুলীকে জাতীয় ক্রিকেট দল থেকে বাদ দেওয়ার যে আক্ষেপ, তা দূরীভূত হয়েছে। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে আসার প্রতিশোধও নেওয়া হলো। মমতা ব্যানার্জি এখন চোখের পাতা পিটপিট করে গলা বড় করে বলতে পারেন, 'আমরা দিল্লির কাছে সম্মান দাবি করছি।'
প্রণব মুখার্জির ভবিষ্যৎ কোথায় যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, এটা এখন বাঙালিদের জন্য ভাবনার সময় নয়। বাঙালি হিসেবে এখন একটি বিষয়ে সবাইকে নিশ্চিত হতে হবে যে ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়াটা অনেক বেশি সম্মানের, কেবল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে। বাড়িটিও বড়, অন্য মাথা মাথা পদের চেয়ে বিনোদনভাতা বেশি এবং সবচেয়ে বড় কথা, কোনো একজনকে অ-বাঙালি কারো কাছে রিপোর্ট করতে হবে না।
একবিংশ শতাব্দীতে দীর্ঘদিনের জাতিগত, ধর্ম ও লিঙ্গবৈষম্যের ধারা পরিবর্তন হতে দেখা গেছে। আমেরিকায় বারাক ওবামা প্রথমত আফ্রিকান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। প্রতিভা পাতিল হলেন প্রথম টেবিল টেনিস খেলোয়াড়, যিনি ক্রিকেটের দেশে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। (কিছু লোক তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়াকে মারাঠাদের গর্ব মনে করেছে। সেটা অচিরেই নিভে গিয়েছিল শিবসেনা তাঁকে সমর্থন দিতে রাজি হওয়ার পর।) করণজোহর প্রথম ভারতীয় হতে পারতেন, যিনি সেরা পরিচালক হিসেবে অস্কার লাভ করেছেন। ঠিক আছে। কিন্তু তা এখনো হয়নি। কারণ আমেরিকার একাডেমী মোশন পিকচার আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স অব্যাহতভাবে একটি ভারতবিরোধী, সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে আছে।
কিন্তু আমাদের এ সময়ে, পুরনোকে ঝেড়ে ফেলার এই সময়ে, প্রণব মুখার্জি আজ শপথ নেবেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, যিনি পূর্বে পাইপ টানতেন, পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির কম উচ্চতাসম্পন্ন, দুর্গাপূজারি, উড়িষ্যার নন এমন একজন কুলীন ব্রাহ্মণ; পড়াশোনা করেছেন সুরি বিদ্যাসাগর কলেজে। প্রিয় বাঙালি, অবশেষে আমাদের সময় এসেছে!

হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধ। ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.