আমাদের চোখের তারায় by প্রণব আচার্য্য

‘দিতে পারো আমায় একশো ফানুস এনে আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।’—(শঙ্খনীল কারাগার) আমরা আগেও হয়তো জোছনা দেখতাম, বৃষ্টিতে ভিজতাম, কিন্তু এই জোছনা কিংবা বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক স্বাভাবিক সৌন্দর্য মনে করিনি এর আগে কেউ-ই।


এসব রবীন্দ্রনাথের গানে আর গীতবিতানের পৃষ্ঠায় পড়ে ছিল শৌখিন অবহেলায়। হুমায়ূন আহমেদই এসব আপাত বিলাসকে আমাদের জীবনের নিবিড় অনুষঙ্গ করে তুলেছিলেন। আমরা, অজস্র তরুণ-তরুণী তাঁর হাত ধরেই তো প্রথম বৃষ্টিতে ভিজতে শিখেছি। শিখেছি জোছনায় আকণ্ঠ মাতাল হতে। পূর্ণিমার সৌন্দর্যের গহিন অভিমান স্পর্শ-সুখে উপভোগ করতে শিখেছি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে। বেঁচে থাকার বহুমাত্রিক প্রেরণা পেয়েছি তাঁর অসংখ্য উপন্যাসে। আত্মদহনক্লান্ত নিজেকে খুঁজে পেয়েছি তাঁর সৃষ্টিরাশির উপমার উৎপ্রেক্ষণে। পেয়েছি ঘুরে দাঁড়ানোর বিস্ময়কর অনুপ্রেরণা। তাঁর হাত ধরেই পরিচয় ঘটে কবিতার সঙ্গে; রবার্ট ফ্রস্ট কি জীবনানন্দ অথবা আমাদের চিরচেনা রবীন্দ্রনাথ, তিনিই আমাদের নতুনভাবে পাঠ করতে শিখিয়েছেন। এই কবিতা অন্তপ্রাণ ঔপন্যাসিকের প্রায় প্রতিটি বইয়ের উৎসর্গপত্রের পরবর্তী পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ থাকত পৃথিবীর কোনো না কোনো কবির উজ্জ্বলতম চরণগুলো। এমনকি বেশির ভাগ বইয়েরও তিনি নামকরণ করতেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দের কোনো পঙিক্ত দিয়ে।
একজন কথাসাহিত্যিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্ভবত নিজের সময়কে প্রভাবিত করতে পারা। লেখনীর মধ্য দিয়ে সমাজের চৈতন্যে পরিবর্তন সাধন করার শক্তি সবার থাকে না। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের এই শক্তিটি ছিল সহজাত। তাঁর চার দশকব্যাপী লেখালেখির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির মধ্যবিত্ত অংশকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। মধ্যবিত্ত সত্তা, এর টানপোড়েন অর্থনৈতিক অবস্থা, এসব কোনো গ্লানি নয়, বরং সংস্কৃতি, এটা হুমায়ূন আহমেদের লেখনীতেই প্রথম সার্থকভাবে উঠে আসে।
বাংলার প্রকৃতিতে বারবার ফিরে আসবে বর্ষা, জোছনাঘন পূর্ণিমা; সমস্ত গ্লানি, হতাশা অতিক্রম করে আমরাও ভিজব বৃষ্টিধারায়, হয়তো আবার সবাই জোছনামুখর রাতে তাকিয়ে থাকব তীব্র চাঁদের দিকে চন্দ্রাহতের মতো। কিন্তু সেদিন পাশে থাকবেন না শুধু একজন, যিনি আমাদের এসব অনুভূতির স্রষ্টা। তবু তিনি থাকবেন। পূর্ণিমার অবিনাশি জোছনার মতো হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন আমাদের চোখের তারায়, সৌন্দর্যের অবিরাম আকাঙ্ক্ষায়।

No comments

Powered by Blogger.