নির্বাচন কমিশনের নড়চড় নে by হারুন আল রশীদ

জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন গণনা শুরু হবে আগামী বছরের অক্টোবর থেকে। তার আগে মার্চ থেকে চারটি সিটি করপোরেশন ও আগস্ট থেকে উপজেলা নির্বাচনের দিন গণনা শুরু হবে। এসব নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য হাতে সময় আছে মাত্র এক বছর।


কিন্তু এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। অথচ কমিশন সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণ এবং কী কী প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নিতে হবে, সে ব্যাপারে এখনই রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আগামী বছরের জুনের আগে সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। নইলে যথাসময়ে ও সুষ্ঠুভাবে এসব নির্বাচন করা কমিশনের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে কোনো রোডম্যাপের কথা আপাতত আমরা ভাবছি না। কারণ, আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্তমান সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগে হবে, নাকি পরে হবে—তা নিয়ে বিভিন্ন রকম কথাবার্তা হচ্ছে। তাই আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।’
এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর আগে ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। ওই রোডম্যাপের আওতায় কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, নির্বাচনী আইন সংস্কার, ছবিসহ ভোটার তালিকা, চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনী আসনের সীমানাবিন্যাস, সংসদ নির্বাচন ও সবশেষে উপজেলা নির্বাচন করেছিল।
বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর ছয় মাস পার হয়েছে। কমিশন সচিবালয়ের সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, এর মধ্যে প্রথম দুই মাস ব্যয় করেছে আগের কমিশনের কাজের আইনি ও আর্থিক অনিয়ম খোঁজার পেছনে। এরপর ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করে। তাও আগের কমিশনের পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায়। এর বাইরে বর্তমান কমিশনের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেই।
দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান কমিশন সদ্য বিভক্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, তফসিল ঘোষণার আগেই কমিশনের উচিত ছিল বিভক্ত ঢাকার ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া। তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েই তফসিল ঘোষণা করা যেত। আর তাতে এই আইনি জটিলতায় পড়তে হতো না।
সংসদ নির্বাচন: বর্তমান জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। এর মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ, আগামী বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য আগামী জুনের আগেই ভোটার তালিকা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ করতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। অবশ্য আগের কমিশন আইন সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। ওই প্রস্তাবের ওপর বর্তমান কমিশনের মতামত চেয়ে নথিটি গত মার্চে ফেরত পাঠিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
বর্তমান কমিশন প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা শেষে নতুন করে প্রস্তাব পাঠাবে। তবে এই পর্যালোচনা কবে শেষ হবে, আর কবে তা সরকারের কাছে পাঠানো হবে, সে সম্পর্কে কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা কিছু জানেন না। তবে নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য আগের কমিশন যে প্রস্তাব করেছিল, বর্তমান কমিশন তা বাদ দেবে, যা সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন ইতিমধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
সিইসির এই বক্তব্যের পর বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনসহ বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন সময়ে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কিন্তু বর্তমান সিইসি মনে করেন, সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে গেলে কমিশনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হবে।
এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনে বলা আছে, নিবন্ধনের জন্য দলগুলোর কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করে কমিশন সময়ে সময়ে নোটিশ জারি করবে। কিন্তু ২০০৮ সালের পর আর একবারও এই নোটিশ জারি করা হয়নি। আগামী নির্বাচনের আগে কত দিনের মধ্যে নতুন দলগুলোর নিবন্ধনকাজ শেষ করা হবে, সে সম্পর্কে বর্তমান কমিশনে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি।
জানতে চাইলে এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনী আইনে বেশ কিছু অসংগতি আছে। সেগুলো নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য এখনই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে। সংসদীয় আসনের সীমানা নতুন করে বিন্যাস করা হবে কি না, সে বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি মনে করেন, আগামী বছরের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ, উপজেলা, চারটি সিটি ও বেশ কিছু পৌরসভায় নির্বাচন করতে হবে। সে জন্য এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে পরে বিপদে পড়তে হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন: আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে। এই চার সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট। আর চার মেয়র শপথ নেন ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর। আইন অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ, আগামী বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই চার সিটির নির্বাচন করতে হবে। তার আগে এসব নগরের ওয়ার্ডের সীমানা পুনর্বিন্যাসের কাজ রয়েছে। কিন্তু এ কাজের জন্য কমিশন থেকে এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি।
নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আগামী বছরের আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে উপজেলা নির্বাচন করতে হবে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এসব স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ কবে শেষ হচ্ছে, কবে থেকে নির্বাচনের দিন গণনা শুরু হবে, সেটা না দেখে বলা যাচ্ছে না।’
তবে কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, উপজেলা নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের আগে নাকি পরে হবে, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এ নিয়েও কমিশনের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। এ ছাড়া কিছু স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, কাগজ, কালিসহ নির্বাচনী মালামাল কিনতে হবে। কর্ণফুলী পেপার মিলকে এক বছর আগে কাগজের চাহিদা জানাতে হয়। ছাপার সময়সূচি জানাতে হবে সরকারি প্রিন্টিং প্রেসকে। কিন্তু এসব বিষয়ে কমিশনে তেমন কোনো আলোচনা বা নড়চড় নেই।
নির্বাচনী কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে হলে এখনই আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান কমিশন গত ছয় মাসে কী কাজ করেছে বা কী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তার কিছুই দেশবাসী জানে না।

No comments

Powered by Blogger.