সাক্ষাৎকার-ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার তালিকায় বাংলাদেশ by শেখর দত্ত

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অজয় দাশগুপ্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুরের সন্তান শেখর দত্ত ভারতের শিল্প-বাণিজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংস্থা কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি বা সিআইআইর সভাপতি ছিলেন। মুম্বাই চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং ইন্দো-ইতালিয়ান চেম্বারের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।


মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যানসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থেকে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শেখর দত্ত লন্ডন থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। ৩৮ বছর একটানা কাজ করেছেন গ্রিভেস কটন লিমিটেডে। এ প্রিয় প্রতিষ্ঠান থেকেই অবসর নেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে। বাংলাদেশে এসেছিলেন সিআইআই প্রতিনিধি দলের কো-লিডার হিসেবে। সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে
সমকাল :ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্মৃতি মনে আছে?
শেখর দত্ত : জন্ম চট্টগ্রামে, শৈশবের স্মৃতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুর ও চট্টগ্রাম, উভয় স্থানেই রয়েছে। আদি নিবাস সুহিলপুরের মাঠা খুব পছন্দ করতাম। আখাউড়া খুব পছন্দের জায়গা ছিল। সাত-আট বছর আগে নিজের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। গ্রামের বয়স্করা আমাদের পরিবারের কয়েকজনকে চিনতে পারলেন। অনেক বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিল। সবটা গ্রহণ করতে পারিনি। কেউ কেউ তো এমনও প্রস্তাব করলেন যে আমি যদি নিজেদের বাড়ি কিনে নিতে চাই, তাতে আপত্তি নেই। বাস্তব কারণেই এমনটি সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি।
সমকাল :আপনি সিআইআইর সর্বোচ্চ পদে ছিলেন। এ সংগঠন সম্পর্কে বলুন।
শেখর দত্ত : ১৮৯৫ সালে এর প্রতিষ্ঠা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আয়রন ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে। ক্রমে নাম পরিবর্তন হতে হতে ১৯৯২ সালে রূপ নেয় কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি বা সিআইআই। এ সংগঠনের সরাসরি সদস্য সংস্থা ৬ হাজার ৬০০। পরোক্ষ সদস্য ৯০ হাজারের বেশি। ভারতে রয়েছে ৬৪টি অফিস। দেশের বাইরে রয়েছে আরও ৯টি অফিস। আমি এখন এ সংগঠনের বাংলাদেশ কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছি।
সমকাল : এ সংগঠন কী ধরনের কাজ করছে?
শেখর দত্ত :আমাদের পূর্বসূরি সংগঠন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আয়রন ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন সেই ব্রিটিশ আমলে যাতে এ অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো থেকে লৌহ ও ইস্পাত পণ্য কেনে সে জন্য সক্রিয় ছিল। সে সময়ে উপমহাদেশের কাজের জন্য ব্রিটেন থেকেই পণ্য আমদানি করা হতো।
ভারত সরকার শিল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মতামত জানতে চায়। বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অংশীদারিত্ব কীভাবে বাড়ানো যায়, এ ক্ষেত্রে কোথায় সমস্যা রয়েছে এবং কীভাবে তার সমাধান হতে পারে, অন্য দেশ ভারতের কাছে কী প্রত্যাশা করে সেসব বিষয়ে আমরা সর্বদা সরকারকে অবহিত করি। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক লাভের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়।
সমকাল : আপনাদের এ সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম রয়েছে কি?
শেখর দত্ত : অবশ্যই। শিল্পের বিভিন্ন শাখায় কোন দেশ কতটা এগিয়েছে এবং কীভাবে এগিয়েছে, আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি সে বিষয়ে সরকার ও উদ্যোক্তা সবাইকে আমরা সুচিন্তিত মতামত দিই। তাদের দিক থেকেও এটা জানতে চাওয়া হয়। এ জন্য অবশ্যই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন পড়ে।
করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর বিষয়ে সদস্যদের সর্বদা সচেতন করাও আমাদের কাজ। কাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। শিল্প-কারখানার উদ্যোক্তাদের এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দক্ষতা বাড়ানো হলে কাজ পেতে সুবিধা হয়, এটা আমরা জানি। শিশু শিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। এসব বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নিই।
আমাদের কখনও কখনও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনায় যেতে হয়। যদি আমরা মনে করি যে সরকারের বিশেষ কোনো নীতি বা কৌশল সঠিক, কিন্তু সে বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য নেই_ এ ধরনের ক্ষেত্রে সিআইআই উদ্যোগী হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে।
সমকাল : ভারতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ গুরুত্ব পায়। এ ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা কী?
শেখর দত্ত :গ্রামীণ উন্নয়নে আমাদের সংগঠন ভূমিকা রাখে। সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে আমরা সরকারের উদ্যোগে সহায়তা দিয়ে থাকি। দেশের অনেক সমস্যা। সরকারের একার পক্ষে তার সমাধান সম্ভব নয়। সরকারি ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে অনেক ধরনের অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প এভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
সমকাল : আপনারা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিষয়ে আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী?
শেখর দত্ত :বাংলাদেশ আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। এ দেশ সম্পর্কে আমার মতো আরও অনেকের ব্যক্তিগত আবেগ কাজ করে। এ দেশটির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানো ভারতের সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। একই কথা বলা যায়, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ সম্পর্কেও। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে পারি যে, এসব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রয়েছে বাংলাদেশের। এ দেশটির সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার। কীভাবে এসব রাজ্যে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগ করতে পারেন, সেটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। আমাদের দুই দেশেরই অনেক বিষয়ে সক্ষমতা রয়েছে, যা পারস্পরিক স্বার্থে কাজে লাগানো যায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এ ধরনের সহযোগিতা অপরিহার্য। স্থল ও নৌ ট্রানজিটও এ ক্ষেত্রে বিবেচিত হওয়া উচিত।
সমকাল :ট্রানজিট প্রশ্নে দুই দেশের অবস্থানে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। জনমতও বাংলাদেশের ভিন্ন...।
শেখর দত্ত :পারস্পরিক লাভজনক না হলে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে বেশি দূর এগোয় না। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যদি দেখে যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের শিল্পপণ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পাঠালে ব্যয় বেশি পড়ে, তাহলে এ পথ তাদের আকৃষ্ট করবে না। তবে আমার মনে হয়, এ প্রস্তাব থমকে আছে রাজনৈতিক কারণে।
সমকাল :বিষয়টি স্পষ্ট করে বলবেন কি?
শেখর দত্ত :হতে পারে যে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ইস্যুর নিষ্পত্তি হয়নি। আমি মনে করি, দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের জন্য তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুর সন্তোষজনক মীমাংসা জরুরি।
সমকাল : বাণিজ্য বাড়ানো কথা বলা হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত বাণিজ্য তো একতরফা ভারতের অনুকূলে। এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হতে পারে?
শেখর দত্ত :বাংলাদেশের রফতানি অবশ্যই বাড়াতে হবে এবং এ জন্য ভারতের তরফে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। ভারতীয় উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের বিনিয়োগ বাড়ালে উৎপাদিত অনেক পণ্য ভারতে রফতানি করা যাবে। এর ফলে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সমস্যারও অনেকটা সমাধান হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ভারতকে আরও একটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে_ দক্ষ জনশক্তি প্রশিক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতি এ ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আরও একটি বিষয়ের সুরাহা করা চাই_ বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের দেশের বাইরে মূলধন নিয়ে যাওয়ার অনুমতি।
সমকাল : একতরফা বাণিজ্যে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু ভারত বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে ...
শেখর দত্ত :বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এটা আমরা চাই না। বাংলাদেশ জনবহুল, তবে অর্থনীতির ভিত এখনও দুর্বল। এখানে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী খুব বেশি নয়। যাদের মধ্যবিত্ত ধরা হয়, তাদেরও উন্নত দেশের বিচারে ক্রয়ক্ষমতা তেমন বেশি নয়। এ অবস্থায় ভারত কতটা রফতানি বাড়াতে পারবে? বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি। সস্তা পণ্য রফতানি বাড়িয়ে বাংলাদেশের বাজারে আরও প্রবেশের ক্ষমতা ভারতের রয়েছে। কিন্তু সেটা যথাযথ হবে না। কারণ তার প্রভাবে এখানের অনেক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমরা বাংলাদেশের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করি এবং একই সঙ্গে চাই যে এখানের অর্থনীতি বিকশিত হোক। ভারতে বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পজাত সামগ্রী রফতানির যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে তাতে ভারতের কিছু ক্ষতি হয়েছে।
কিন্তু আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। এখানের বস্ত্রশিল্পে ভারতীয়রা বিনিয়োগ বাড়ালে এ খাতে রফতানি আরও বাড়তে পারে। ইস্পাত খাতেও বিনিয়োগ হতে পারে। এ জন্য ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান স্থাপনই ভালো হবে বলে আমি মনে করি। চট্টগ্রাম বন্দরেও বিনিয়োগের সুযোগ বিবেচনা করা যায়। কৃষি খাতে গোদরেজ গ্রুপ ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করেছে। আরও উদ্যোক্তারা এ খাতে এগিয়ে আসতে পারেন।
সমকাল : এবারের ঢাকা বৈঠকের মূল অর্জন কী?
শেখর দত্ত : ভারতীয়রা এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর ছাড় দিয়েছে। বিনিয়োগের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলও তারা চাইছে। এসব প্রস্তাব ইতিবাচক মূল্যায়ন পাবে বলে আশা করব।
সমকাল :সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য ধন্যবাদ।
শেখর দত্ত : সমকাল পাঠকদের ধন্যবাদ।
 

No comments

Powered by Blogger.