সরকারের নতিস্বীকার-তাতেই কি মিলবে বিশ্বব্যাংকের ঋণ?

অবশেষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকেই বিদায় নিতে হলো। খবরে প্রকাশ, তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, কিন্তু কৌশলগত কারণে নাকি সেটি প্রকাশ করা হচ্ছে না। এর আগে গত ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।


কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। সে কারণে প্রায় ১৪ মাস ঝুলিয়ে রেখে গত মাসে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে মালয়েশিয়ার বিকল্প প্রস্তাব প্রদানের এক দিন পর বিশ্বব্যাংক সেতুর ঋণচুক্তিটি বাতিল করে দেয়। সরকার তখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় এবং দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রায় অনুদান নেওয়ার জন্য দুটি ব্যাংক হিসাব খোলে। অবশ্য একই সঙ্গে সরকারের অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের মত পাল্টানোর জন্য যোগাযোগও করতে থাকেন। এ পর্যায়ে এসে সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ নিঃসন্দেহে অর্থবহ। কিন্তু সেই অর্থটা কী? বিশ্বব্যাংক কি পুনরায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে? নাকি আরো বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আর আবুল হোসেনকে যদি মন্ত্রিসভা থেকে সরানোই হবে, তাহলে আরো আগে সরানো হলো না কেন? মাঝখানে এত নাটক করা হলো কেন? দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো কেন? এমন সব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।
আমরা নিকট-অতীতে বিশ্বব্যাংক, আবুল হোসেন ও তাঁর পরিবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল নিয়ে অনেক মুখরোচক খবর ও মন্তব্য পড়েছি। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে নাকি ঘুষ লেনদেনের চেষ্টা করা হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম, এবার হয়তো 'বিশ্বব্যাংক ও আবুল হোসেন' উপাখ্যানের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু না, তা হয়নি। আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরানোর কয়েক দিন পরই জানা গেল, এবার খোদ বিশ্বব্যাংক আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালকে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ প্রদানের সুপারিশ করেছে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জে ৪৫০ মেগাওয়াটের একটি সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি) গত বছর দরপত্র আহ্বান করেছিল। এতে অংশ নিয়ে স্পেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ কম্পানি আইসোলেক্স-স্যামসং জেভি ৩৪২ মিলিয়ন ডলার ও ফ্রান্সের কম্পানি কোবরা ৩০০ মিলিয়ন ডলারের দরপত্র জমা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত লাগলেও বিশ্বব্যাংক তখন কাজটি আইসোলেক্স-স্যামসংকেই দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। আর এই আইসোলেক্স-স্যামসংয়ের স্থানীয় প্রতিনিধি হচ্ছে সাকো ইন্টারন্যাশনাল। আর বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ তো আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য নির্দেশের শামিল। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের এসব খেলা বোঝা খুবই মুশকিল। কিন্তু এটাই সত্যি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো অর্থলগি্নকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশকে নতিস্বীকার করতেই হবে। তার কারণ আমাদের মতো দেশগুলোর সরকার ঋণ করতে ভালোবাসে এবং ঋণের টাকায় পদ্মা সেতু কিংবা বিমানবন্দরের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে খুবই আগ্রহী হয়। এমনকি দেশের স্বার্থের বিপরীতে গিয়েও এসব দেশ ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করে এবং এমন সব শর্ত মেনে নেয়, যা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে শক্ত করার বদলে আরো দুর্বল করে দেয়। আমরা চাই না, বিশ্বব্যাংকের ঋণ পেতে বাংলাদেশ তেমন কোনো শর্ত মেনে নিক অথবা আত্মমর্যাদা খুইয়ে কিছু করুক। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে যদি মন্ত্রিসভা থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তাকে স্বাগত জানাই এবং এটা অনেক আগেই কাম্য ছিল।

No comments

Powered by Blogger.