বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা

বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা নুরে আলম দুর্জয়, আহমেদ জায়িফ, মাসুম বিল্লাহ, মেহেরুল হাসান সুজন, শেখ আল এহসান এএম জাহিদ, লাকমিনা জেসমিন সোমা, গোলাম মুজতবা, শামসুজ্জামাস শামস, আশিক হোসেন, সানাউল্লাহ সাকিব তনু, ওয়ালিউল্লাহ, আবদুল্লাহ আল মামুন, ইফতেখার ফয়সাল মাসউদুল আলম, নির্ঝর মজুমদার, সুজন ঘোষ, এমদাদুল হক ও রাজীব নন্দী


শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের প্রতি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ উদ্দিনের সাম্প্রতিক এক দম্ভোক্তি প্রসঙ্গে আমরা আমাদের যৌথ মতামত তুলে ধরছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা উপাচার্যের কাছে একজন সতীর্থ সাংবাদিকের বহিষ্কারের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, 'সাংবাদিক বলতে কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের সংবাদ পাঠানো লাগবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেস ক্লাবের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।' ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস এ সময় বলেন, 'শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিলেট প্রেস ক্লাব মাত্র দুই কিলোমিটারের পথ। তিন কিলোমিটার গেলে সব স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর অফিস পাওয়া যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সাংবাদিকের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। শহরের সাংবাদিকরাই এখান থেকে নিয়মিত নিউজ করতে পারবে। এখানে অধ্যয়নরতদের শিক্ষানবিশ ও পার্টটাইমের কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টে ছাত্রদের সাংবাদিক বলে আলাদা পরিচয় বহন করার মতো কাউকে অধিকার দেওয়া হয়নি। যে সাংবাদিককে বহিষ্কার করা হয়েছে তাকে সাংবাদিক হিসেবে নয় বরং ছাত্র হিসেবে বহিষ্কার করা হয়েছে।' সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক বলেন, 'সাংবাদিকদের শাস্তি দেওয়ার বিধান যদি দেশের আইনেও না থাকে তাহলেও আমরা দেব' (বার্তাটুয়েন্টিফোর ডট নেট যঃঃঢ়://নধৎঃধ২৪.হবঃ/হবংি/৭২৫- সাংবাদিক বলতে কিছু নেই : শাবি উপাচার্য)। এই সংবাদটি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। উপাচার্যের মুখে এসব শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছি। কিন্তু সাংবাদিকতার ওপর এই হুমকি আজ নতুন নয়। আমাদের দেশের প্রধান চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আজ একই চিত্র।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে আহত হয় এক ফটো সাংবাদিক। ১৬ মে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইমন রহমানকে মারধর করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক সমিতির সভাপতি পলাশ মাহমুদ এবং সাধারণ সম্পাদক সাঈদ জুনায়েদ, দৈনিক শক্তির জাবি প্রতিনিধি ইকবাল হোসাইন সৈকতকে ছাত্রলীগ কর্মীরা মারধর করে। এ ঘটনার এখনও কোনো বিচার হয়নি। এর আগে সাংবাদিক সমিতির সভাপতি রেজাউল হক কৌশিককে মারধর করলে প্রশাসন অভিযুক্ত শামীমকে এক মাসের জন্য বহিষ্কার করে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, যে দু'জনকে এক মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল, তা কার্যকর হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির সময়। কার্যত তাদের কোনো শাস্তিই ভোগ করতে হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সালের মে মাসে উপাচার্য অধ্যাপক আলতাফ 'বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের নীতিমালা' শিরোনামে এক পাতার একটি কাগজ সরবরাহ করেন সাংবাদিকদের। তাতে লেখা ছিল কীভাবে সাংবাদিকতা করতে হবে, প্রশাসনের কোন কোন বিষয় লেখা যাবে, কোনটি লেখা যাবে না ইত্যাদি। হাস্যকর এই নীতিমালা দেওয়ার ১৫ দিনের মাথায় অবশ্য অধ্যাপক আলতাফ তার পদ থেকে অপসারিত হন। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান গত বছরের ১৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল পরিচয়পত্র প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গিয়ে অধ্যাপক আবদুস সোবহান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের 'হলুদ সাংবাদিক' আখ্যা দিয়ে 'আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সাংবাদিক দরকার নেই' বলে মন্তব্য করেন। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেছে এই ক্যাম্পাসে। প্রতিটি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্যাডার আর কর্মীদের হাতে। ২০০৭ সালের ৫ আগস্ট ছাত্রশিবিরের হাতে চার সাংবাদিক, ২০০৮ সালের ১৫ জুলাই তিন সাংবাদিক, ২০০৯ সালের ২ জুন ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে দুই সাংবাদিক, ২০০৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দু'জন, ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি একজন, ৯ জুন একজন, ২০১০ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হাতে আহত হয়। গত দুই বছরে ক্যাম্পাসের দুটি সাংবাদিক সংগঠনের কার্যালয় বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে সিলগালা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব বন্ধ করে দেয় বর্তমান প্রশাসন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করে দেন বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়। এখনও এই দুটি কার্যালয় বন্ধ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দু'বছরে পুলিশ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত দশ সাংবাদিক। ২০০৯ সালের ১৫ মে দৈনিক আমার দেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাশেদ খান মেননকে পেটানোর মাধ্যমে শুরু হয় সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাংবাদিক নির্যাতন। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেট এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি এমদাদুল হককে। একই দিনে অপর এক সাংবাদিককে মাথা কেটে ফেলার হুমকি দেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। একই বছরের ২ আগস্ট বর্ধিত বেতন-ফি নিয়ে পুলিশ-শিক্ষার্থীর সংঘর্ষের সময় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। এ সময় পুলিশ দৈনিক কালের কণ্ঠের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাজীব নন্দীকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। ওই দিন পুলিশের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন দৈনিক ইত্তেফাকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি এমদাদুল হক, শীর্ষ নিউজ ডটকমের নাসিমুল আহসান। সেদিনই ক্যাম্পাসের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় বিস্ফোরক দ্রব্য বহন ও অগি্নসংযোগের মামলা! একই দিন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হামলার শিকার হন দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের সংবাদদাতা ওমর ফারুক। গত ৬ ডিসেম্বর ডেইলি সানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নির্ঝর মজুমদারকে শাটল ট্রেনে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপ ককপিটের কর্মীরা। এই ঘটনার মাস না যেতেই শাটল ট্রেনে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন দৈনিক ডেসটিনির প্রতিনিধি মাসউদুল আলম এবং দৈনিক খবর প্রতিনিধি হুমায়ুন মাসুদ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় বহুবার পত্রিকার শিরোনাম হয়। প্রতিটি ঘটনার পরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিচারের আশ্বাস দিলেও এ পর্যন্ত বিচার হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও ঢাবিতে ছাত্রলীগ তাদের অপকর্মের ধারা অব্যাহত রেখেছে। গত ১৯ মাসে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও মাদক ব্যবসার মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ সাংবাদিকদের ওপর আগ্রাসী হয়ে উঠেছে অন্তত ৫ বার। এদিকে এ বছরই একুশের প্রথম প্রহরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে সাংবাদিকরা শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েও প্রশাসনের আমলাতান্ত্রিক বিধিনিষেধের মধ্যে পড়েছে।
সাংবাদিকের কক্ষে অগি্নসংযোগ, ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার আর মামলা করে সাংবাদিকতা বন্ধের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা দ্বিগুণ অনুসন্ধানী মন নিয়ে জ্বলে ওঠার শপথ নিচ্ছি। সাংবাদিকতার মর্যাদা আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে এই সক্রিয়তার কোনো বিকল্প নেই। আপসহীন সাংবাদিকতা আর গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবিতার জয় হবেই। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি আমাদের আহ্বান, বহিষ্কৃত সাংবাদিকের নিষেধাজ্ঞা দ্রুত প্রত্যাহার করুন এবং আপনার দম্ভোক্তির জন্য জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক ও দেশের আপামর জনতার কাছে দুঃখ প্রকাশ করুন।

লেখকবৃন্দ : ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.