চরাচর-সোহাগপুর গণহত্যা by হাকিম বাবুল

নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের ছয় ঘণ্টার তাণ্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেত-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় 'বিধবাপল্লী'।


স্বজন হারানোর দুঃখ-বেদনার ক্ষত আর সে দিনের বিভীষিকা নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন অনেক মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই বিধবাপল্লী এক আলাদা স্থান দখল করে আছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যসংলগ্ন সবুজ-শ্যামলিমা, পাখির কলকাকলি ভরা এই গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে বুড়ি ভোগাই নদী। দক্ষিণে গ্রামটিকে অনেকটা লতার মতো জড়িয়ে আছে আরেকটি নদী সুতিয়া। পশ্চিমের দুটি গ্রাম বেণুপাড়া ও রসাইতলা।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই (শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখ) সকাল ৭টার দিকে গ্রামের মানুষ যখন ক্ষেত-খামারে গিয়ে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় ১৫০ জনের একটি দল গ্রামের প্রফুল্ল দীঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নির্দেশে (বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন) স্থানীয় রাজাকার কাদির ডাক্তার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে সোহাগপুর নিয়ে আসে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সময় তারা গ্রামের ছেলে-বুড়ো-শিশু- যাকে যেখানে পায় সেখানেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। অনেককেই বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। মধ্যযুগীয় কায়দায় নরঘাতকের দল স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে সন্তানকে বাড়ির উঠানে ফেলে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে পানি পানি করে চিৎকার করেছিল সবাই।
স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে প্রথমে বঙ্গবন্ধু সরকার তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা দান করে। ১৯৯৬ সালে ফের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। দীর্ঘসময় পর ২০০৮ সালে শেরপুর জেলা প্রশাসন ও অনির্বাণ-৩০-এর সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই গ্রামের বীর শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে স্মৃতিফলক নির্মাণ ও গণকবর চিহ্নিত করেন। এ সময় শহীদ পরিবারের বিধবাদের পুনর্বাসনের জন্য আয়বর্ধনমূলক প্রকল্প গ্রহণ করলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো এখন আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। সরকারিভাবে বর্তমানে শহীদ পরিবারের বেঁচে থাকা ৩৩ জন বিধবাকে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা ছাড়াও ২০১০ সালে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সহায়তায় ট্রাস্ট ব্যাংক মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করায় তারা এখন কোনোমতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারছে। ব্র্যাকও তাদের ২০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব শহীদ পরিবারের বিধবাদের জন্য আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার মতো 'শহীদ পরিবার ভাতা' দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্থানীয় মুক্তযোদ্ধারা এসব শহীদ পরিবারের বিধবাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার দাবি জানিয়েছেন।
হাকিম বাবুল

No comments

Powered by Blogger.