নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি by তানভীর সোহেল

সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে এখন আগামী নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার কাছ থেকে এ কথা জানা গেছে। তাঁদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা এক বছরের আন্দোলনে সরকারকে বড় কোনো চাপে ফেলতে পারেনি বিএনপি।


উপরন্তু, বিভিন্ন মামলায় সরকারই বিএনপিকে চাপে ফেলেছে। একই সঙ্গে দলে ভাঙন ধরাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন তৎপরতা বিএনপির জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন নেতারা, বরং মাঠপর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে হতাশা রয়েছে।
অবশ্য বিএনপির নেতারা মনে করছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাঁদের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত। তাই তাঁরা আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে একরোখা অবস্থানে নেই। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মোটামুটি নির্দলীয় একটা ব্যবস্থা হলেই বিএনপি খুশি। এ নিয়ে নির্বাচনের আগে আগে সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতা হবে বলে আশা করছেন নেতারা। আর এ ক্ষেত্রে ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করতে’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়ক ভূমিকাও প্রত্যাশা করছে বিএনপি।
বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে একটা সমঝোতা হবে, এমনটা ধরে নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোন আসনে কে প্রার্থী হবেন, এটা নিয়েও দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের বুদ্ধিবৃত্তিক একাধিক সংগঠনকে দিয়ে নির্বাচনপূর্ব সাংগঠনিক অবস্থার জরিপ করা হচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করলে জনগণের মনোভাব কী হবে, তা বোঝার চেষ্টা চলছে।
একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে বন্ধুপ্রতিম ও প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধানে বর্তমানে যে ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, তার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটি ও মাঠপর্যায়ের নেতারা এমন কথাই বলেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে। তারা এটা ফিরিয়ে আনবে বলে মনে হয় না। আবার ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনও সম্ভব নয়। একটা অবস্থানে সরকারকে আসতেই হবে।
মাঠপর্যায়ে হতাশা: বিএনপির নেতারা মনে করেন, সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ভোটের মাধ্যমে এই সরকারকে হটাতে জনগণ মুখিয়ে আছেন। তবে তাঁদের জন্য কয়েকটি বিষয় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎসংকট, শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের মতো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সাধারণ মানুষকে মাঠে নামাতে না পারা, কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনায় হঠাৎ চুপসে যাওয়া, হরতালে গাড়ি পোড়ানোর এক মামলায় কেন্দ্রীয় নেতাদের পিছু হটা, সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েও বড় কোনো কর্মসূচি দিতে না পারায় দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা আছে বলেও একাধিক নেতা স্বীকার করেছেন।
দলের ভাঙন ঠেকাতে তৎপরতা: এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে ভাঙার তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে কয়েকজন নেতাকে নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, ঢাকার কয়েকজন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সম্পাদক, সাংসদ ও জেলা পর্যায়ের নেতাও আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সরকারের কোনো কোনো সংস্থার তৎপরতায় দলের সম্ভাব্য ভাঙন ঠেকাতে খালেদা জিয়া নিজে তৎপর হয়েছেন। ২০০৭ সালের এক-এগারোর সময়ের কথিত সংস্কারপন্থী নেতাদেরও দলে অন্তর্ভুক্ত বা সক্রিয় করতে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ছোট আকারের হলেও দলের কাউন্সিল করার চিন্তাভাবনা আছে। দলে বঞ্চিতদের কাউন্সিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। সংস্কারপন্থীদেরও পদ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে দলের কেউ কেউ যে জড়িত, তা দলীয় চেয়ারপারসনের অজানা নয়। তিনি গত ৮ এপ্রিল দলের নির্বাহী কমিটির সভায় এটা বলেছেনও। তবে চেয়ারপারসন চান সবাইকে এক করে এগিয়ে যেতে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, সরকার দল ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে। অনেক নেতার সঙ্গে তারা যোগাযোগও করছে। কিন্তু এটা কিছুতেই সফল হবে না। এর আগে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সফল হয়নি।
ডিসেম্বরের আগে বড় কর্মসূচি নয়: দলের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুম, তারপর রোজা, দুই ঈদ, হজসহ বিভিন্ন কারণে আগামী ডিসেম্বরের আগে বড় কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, বিএনপি আন্দোলন করেই দাবি আদায় করবে। তবে জনগণের দুর্ভোগ হয় এমন কোনো কর্মসূচি আপাতত দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না। এর পরিবর্তে অবরোধ, অনশন, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশের কর্মসূচি দেওয়া হবে।
আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, আবার হরতাল ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচিকে আমলে নিতে চায় না সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল হরতালের বিরুদ্ধে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার প্রতিবাদে টানা পাঁচ দিনের হরতালকে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেননি। প্রথম দুই দিন সমর্থন থাকলেও এরপর তা ধরে রাখা যায়নি। এই অবস্থায় কঠোর আন্দোলনে যেতে আরও সময় নেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। তাই আপাতত সরকারকে খ্যাপাতেও চাচ্ছে না দলটি। এই সময়ে দলের অভ্যন্তরীণ সংকট কাটানো এবং গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের জামিন-মুক্তির চেষ্টা চালাবে বিএনপি।
হিলারি-প্রণবের সফরে আশাবাদী হতে পারেনি বিএনপি: গত মে মাসে ঢাকা সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের জন্য এই দেশ দুটির গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তি খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হিলারি ও প্রণবের সফরকে ঘিরে দলের মধ্যে যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল, সফর শেষে তা মিলিয়ে গেছে। বিএনপির প্রত্যাশা ছিল, নির্দলীয় সরকারের দাবি মানার ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ওপর চাপ দেবেন। কিন্তু তেমনটা হয়নি। তিনি শুধু সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন।
আর প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎও খুব ফলপ্রসূ হয়নি বলে জানান ওই নেতা। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারের ওপর নির্দলীয় সরকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক কোনো চাপ নেই। এখন বিএনপি মনে করছে, তারা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে না নিতে পারলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে তেমন কোনো সহায়তা পাওয়া যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.