বন প্রাণবৈচিত্র্য সভ্যতার নাভিবিন্দু by পাভেল পার্থ

জাজাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ অনুযায়ী বন প্রাণবৈচিত্র্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ব্যাপক অর্থে বন প্রাণবৈচিত্র্য বলতে একটি বনভূমির অন্তর্গত সব বৃক্ষ-প্রাণী-অণুজীবের সমাহার ও সম্পর্ক এবং এদের প্রতিবেশীয় ধারা ও ক্রিয়াশীলতাকে বোঝায়। একটি বনের সব জীববৈচিত্র্যই বনের প্রাণবৈচিত্র্য।


বাংলাদেশের বিদ্যমান কোনো বননীতি ও আইনে 'বন প্রাণবৈচিত্র্য'-এর প্রসঙ্গ স্বীকার করা না হলেও সাম্প্রতিক 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০'-এ উল্লেখ করা হয়েছে 'জীববৈচিত্র্য' অর্থ জল, স্থল ও সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমে বসবাসকারী সব প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বা উপ-প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক এবং প্রজাতিগত ভিন্নতা অথবা তাদের ইকোসিস্টেমের ভিন্নতা। একটি বনের এ প্রজাতি ও বাস্তুসংস্থানের বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু সচরাচর আমরা দেখছি, রাষ্ট্র বনের স্থানীয় বন প্রাণবৈচিত্র্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বহিরাগত আগ্রাসী প্রজাতির বাণিজ্যিক প্রকল্পকে। অথচ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০ ঘোষণা করেছে, 'আগ্রাসী (ওহাধংরাব) প্রজাতি'_ অর্থ, কোনো নির্দিষ্ট ইকোসিস্টেমের বহির্ভূত প্রজাতি যাকে তার ইকোসিস্টেমের বাইরে অন্য কোনো ইকোসিস্টেমে স্থানান্তর করলে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়। আগ্রাসী প্রজাতি উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অন্যান্য অর্গানিজম (যেমন মাইক্রোবস) হতে পারে। বাংলাদেশের সব প্রাকৃতিক বনভূমিসহ দেশের সব অঞ্চলে আইনগতভাবে আগ্রাসী প্রজাতিগুলো নিষিদ্ধ করা জরুরি। কারণ একাশিয়া, ইউক্যালিপটাসসহ সব আগ্রাসী প্রজাতি আমাদের স্থানীয় বাস্তুসংস্থান ও প্রতিবেশে তৈরি করছে এক দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা। বলা হয়ে থাকে, কোনো দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি সে দেশে থাকা আবশ্যক। দেশে কত ধান-চাল উৎপাদিত হয় এবং কত মানুষ আছে তা জানা যেমন কষ্টের তেমনি তার চেয়েও কষ্টের কাজ দেশের বনভূমির সঠিক পরিসংখ্যান এবং পরিস্থিতি জানা। বাংলাদেশে সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, দেশের ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩৪ একর বনভূমি বাংলাদেশ বন বিভাগের আওতাধীন। কিন্তু এসব বনভূমি দিনে দিনে বৈচিত্র্যহীন ও বিভিন্ন উন্নয়ন-জখমের আওতায় পড়তে বাধ্য হচ্ছে। বন প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর এ উপর্যুপরি অন্যায় আঘাত ইতিমধ্যেই আমাদের জন্য সংঘাত ও সর্বনাশ ডেকে এনেছে। সিডর ও আইলার মতো দুটি সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা সামাল দিয়েছে আমাদের সুন্দরবন। অথচ আমরা বেমালুম বনভূমির এসব জানবাজি রাখা ভূমিকার কথা ভুলে গিয়ে প্রতিনিয়ত বনভূমি বাস্তুসংস্থান ও বন প্রাণবৈচিত্র্যকে সমূলে উপড়ে ফেলছি। জাতিসংঘের সাধারণ সভার দ্বিতীয় কমিটিতে প্রথম উত্থাপিত হয় 'আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস'-এর কথা। ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি পালিত হয় প্রতি বছরের ২৯ ডিসেম্বর। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের তারিখটি পরিবর্তিত হয়ে পুনরায় এটি ২২ মে নির্ধারিত হয়। ২০১১ সালকে আন্তর্জাতিক বনবর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বছরের প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য 'বন প্রাণবৈচিত্র্য'। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের 'আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২' স্বাক্ষর করে। পরে ১৯৯৮ সালে 'ইরড়ফরাবৎংরঃু ধহফ ঈড়সসঁহরঃু শহড়ষিবফমব ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ অপঃ ১৯৯৮' নামে একটি খসড়া তৈরি করে।
এক অতি আশ্চর্য ও রহস্যময় কারণে দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় এক শীতনিদ্রার ভেতর রাখা হয়েছে এ আইনকে। দ্রুত দেশের পরিবর্তিত জনচাহিদা ও অরণ্যনির্ভর জনগণের মতামত এবং পরামর্শের ভেতর দিয়ে আইনটি কার্যকর করে তোলা জরুরি। রাষ্ট্রকে বননির্ভর ও বনজীবী জনগণের লোকায়ত অরণ্য বিজ্ঞান এবং বন প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর জীবন গুরুত্ব দিয়েই দেশের ক্ষয়িষ্ণু বনভূমি ও বন প্রাণবৈচিত্র্য আখ্যানের প্রতিবেশীয় ন্যায়বিচার নিশ্চিত
করতে হবে।
animistbangla@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.