বাপ্পীর বৃষ্টি দেখা by মোঃ নজরুল হাসান ছোটন

আমি আর বাপ্পী একই স্কুলে পড়ি। স্কুলের হোস্টেলে একই রুমে দু’জন থাকি। তাই দু’জনেই প্রায় সব সময়েই কাছাকাছি থাকি। আমি বাপ্পীকে সব সময়েই কেমন যেন মনমরা দেখতাম। ওর ঘোমরা মুখে মনে হয় কখনও হাসি দেখতাম না।


দেখলেও খুব অল্প সময়েই দেখতাম। ওর এই ঘোমরা মুখের কারণ কি? তা আমার জানার ভীষণ আগ্রহ হলো।
আজ বিকেল বেলা থেকেই বাইরে কিছু কিছু বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল। বাপ্পীকে এই সময়ে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে বাপ্পী আমি সব সময়েই তোকে কেমন যেন মনমরা দেখি? মনে হয় তোর মনের মাঝে লুকিয়ে আছে কোন এক অসীম দুঃখের সাগর! তুই তো কোন দিন আমাকে তোর মনের দুঃখের কথা বললি না। আজ আমরা দু’জন ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। আজকেই আমার কাছে তোর দুঃখের কথাটি বল।
আমার কথায় বাপ্পীর দু’চোখ ছল ছল হয়ে গেল। বলল, কোয়েল তুই কি শুনবি আমার দুঃখের কথা? কেউ তো কোন দিন আমার দুঃখের কথা শুনতে চায়নি। তুই যখন শুনতে চাস। তখন তোকেই বলি। আজ মনে হলো তুই-ই আমার একমাত্র আপন বন্ধু।
বাপ্পী তখন তার দুঃখের কাহিনী বলা শুরু“ করল। বাপ্পী বলল, আমার আব্বা যখন চট্টগ্রামে চাকরি করত। আমি তখন ক্লাস টুতে পড়তাম। আমাদের বাড়িটি ছিল কক্সবাজারে। সেই সময় ছিল বর্ষাকাল। আমাদের বাড়ির চারপাশে অল্প অল্প পানি বাড়তে ছিল। বন্যার সম্ভাবনা ছিল। তবে বেশি পানি বাড়েনি বলে আমাদের স্কুল বন্ধ দেয়া হয়নি। আব্বার জ্বর ছিল বলে কয়েকদিন যাবত অফিসে যায়নি। আমাদের স্কুলটি ছিল একটি টিলার ওপর। সেদিন অন্যান্য দিনের মতো স্কুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ স্কুল হতে কেমন যেন একটা বিদঘুটে শো শো আওয়াজ শোনা গেল। ক্লাসে স্যার ছিল। আমরা সকল ছাত্র তাকে কিসের আওয়াজ, জিজ্ঞেস করলাম। স্যার কিছুক্ষণ আওয়াজটি শুনে বললেন, সর্বনাশ! এ যে বন্যার-বানের আওয়াজ।
স্যার দৌড়ে ক্লাসের বাইরে এলেন। তার সঙ্গে আমরা ছাত্ররাও ক্লাসের বাইরে এলাম। স্কুল হতে আমাদের বাড়িটি দেখা যেত। কিন্তু আমাদের বাড়ির কোন চিহ্নই দেখা গেল না! কেবল দেখতে পেলাম পানি ফুলে ফুলে ওপরের দিকে উঠছে! আমি বাড়িতে যেতে চাইলে স্যার আমাকে হাতের মুঠোতে ধরে বললেন, পাগল হয়েছ নাকি? তুমি গেলে যে তুমিও মরবে!
তাই স্যারের কথায় স্কুলেই দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর বানের পানি আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল। তখন দেখতে পেলাম কেবল চিকচিকে বালিগুলো। আমি আর এক মিনিটও অপেক্ষা না করে দৌড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু বাড়ির কোণের চিহ্নই বুঝতে পাড়লাম না। আমাদের ঘরটি ভেঙ্গে গিয়ে জনশূন্য হয়ে আছে। আব্বা, আম্মা, ছোটভাইÑকেউ নেই। রাক্ষসী! সর্বগ্রাসী! বন্যার বান আমার আব্বা, আম্মা, ভাইকে সমুদ্রের অতলগর্ভে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে!
বানের খবর পেয়ে মামা আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। কিছুদিন সেখানে থাকার পর মামা আমাকে এই স্কুলে ভর্তি করিয়ে এই হোস্টেলে দিয়ে গেলেন। তারপর হতেই আমার হোস্টেল জীবন শুরু। সবকিছু পেলেও আমি তো আর কখনও আব্বা-আম্মা-ভাইকে ফিরে পাবো না। তাদের মৃত্যুর জন্য তো দায়ী একমাত্র বর্ষার বান! তাই আমার সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে সর্বগ্রাসী বান ও বন্যার ওপর। কারণ ওরা আমার জীবনের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে!
বাপ্পী তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি বলতে বলতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমি ওকে সান্ত¡না দেবার কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমার দু’চোখ ও অশ্রুতে ছলছল হয়ে এল।

No comments

Powered by Blogger.