মানুষের জন্য মুনতাসির by সৈয়দ আখতার ইউসুফ

আমি যে -দৈনিক সকালের খবর- ছেড়েছি তা সহকর্মী বা পরিবারের অনেকের জানার আগেই সুদূর আমেরিকায় বসে আমার বোন জেনে গেলেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটল যখন জানলাম এ আমার বড় ছেলে ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ মুনাভির ইউসুফের কা-।


গত তিন তিনটি বছর যাবৎ সে যে প্রত্যহ প্রয়াত ভাইটির (মরহুম ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ মোহাম্মদ মুনতাসির ইউসুফ) সঙ্গে ‘ফেসবুক’-এ কথোপকথনের মাধ্যমে দিবসের সব ঘটনা অবহিত করে তা আমার জানা ছিল না। বুঝলাম ফেসবুক থেকেই খবরটি আমার আমেরিকা প্রবাসী একমাত্র বোন জাহানারা সোবহানী জেনেছেন।
আমাদের কনিষ্ঠ সন্তানটি নেই আজ তিন বছর। ২০০৯ সালের ৬ জুলাই সে ইহলোক ত্যাগ করে। মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ার মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ২৪ বছরের সন্তানটি আমাদের ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে তার মা নামাজান্তে জায়নামাজে বসে ছেলের জন্য প্রার্থনা করেন। বড় ভাই কথা বলে ‘ফেসবুক’-এ। আর আমি অভাগা? না, আগের মতো প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে দু’একবার গিয়ে দাঁড়াই আজিমপুর কবরস্থানে সন্তানের কবরের পাশে। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন? আজিমপুরের সুবিশাল কবরস্থানে সারি সারি হাজার হাজার কবর। এরই মাঝখানে মসজিদের পাশে সন্তানের কবরের সামনে যখন দাঁড়াই ভাবি এইতো জীবনের শেষ পরিণতি। এ পরিণতি তো আমাদের সবার জন্যই অপেক্ষা করছে। মৃত্যুর হাত থেকে তো রেহাই পাবার পথ নেই। আমাদের আদরের ছোট্ট সন্তানটিও তো বাঁচতে চেয়েছিল। পিতা-মাতার সামর্থ্যরে কথা ভেবেই হয়তো বলেছিল, ব্যাঙ্কক-সিঙ্গাপুর নয় প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে একবার দেখালে হয় না! হ্যাঁ, নিয়ে গিয়েছিলাম মুম্বাই। সেখানে প্রখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সুরেশ আদভানীর চিকিৎসাধীন ছিল ৭-৮ দিন। তারপর তার পরামর্শে দেশে ফিরে আবারও স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। কিন্তু না, ছেলেকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। ‘বাবা আমি বাঁচতে চাই; আমাকে মরতে দিও না মা’ শেষ বেলায় তার চোখে মুখের সেই নীরব আর্তি আজও আমাদের কাঁদায়। ছিন্নভিন্ন করে দেয় হৃদয়।
নিজ সন্তান বলে বলছি না, এ যুগে এমন যুবকের সন্ধান সচরাচর মেলে না। কত উদাহরণ দেব? সে নেই আজ ৩ বছর। এই সহস্রাধিক দিবসের প্রায় প্রতিটি দিন আমাদের সন্তান নব নব রূপে ধরা দিচ্ছে। কত দীন-দুঃখী যে তার হাত খরচের পয়সায় জীবনযাপন করেছে, কত ফেরিওয়ালার ক্ষুদ্র পুঁজি যে তার সঞ্চয় থেকে জুগিয়েছে, কত মৃত্যু পথযাত্রীকে যে সে হাসিমুখে রক্ত দান করে গেছে সেসব কাহিনী আমাদের কাছে অজানাই রয়েছিল। দিন যত যায় ততই লোকমুখে তার চরিত্র মাধুর্যের কথা শুনি। গর্বে বুক ভরে ওঠে। দুঃখের তিমিরেও মঙ্গলালোকের ঝলকানি দেখতে পাই। সন্তানের পরকালের সুখের আশায় সকল দুঃখ ভুলে যেতে চাই। কিন্তু, তা কি কখনও সম্ভব? জানি না। তবে এটা নিশ্চিত যে, যেখানে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ, যেখানে আর্তের সেবা, যেখানে সত্য-সুন্দর সততার জয়গান, ‘যেখানে মানুষ মানুষের জন্য’ মন্ত্রে দীক্ষিত প্রতিটি মানবসত্তা, সেখানেই খুঁজে পাব আমাদের সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ মুনতাসির ইউসুফকে।

লেখক : সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও বিএফইউজে

No comments

Powered by Blogger.