যে 'গলতি' বারবার হয় by রণজিৎ বিশ্বাস

: আপনি কখনও আমেরিকা গেছেন?
: গেছি। এই জুনে আরেকবার যাওয়ার কথা।
: ভারত গেছেন?


: অনেকবার। দাফতরিক-অদাফতরিক মিলিয়ে প্রায় বারোবার।
: কানাডা গেছেন কখনও?
: একবার। আগামী তিন মাসের মধ্যে আবার যাওয়ার সম্ভাবনা।
: দেশগুলো কেমন?
: সুন্দর। একেক দেশের একেক আকর্ষণ।
: দেশগুলোর মাটিতে পা রেখে আনন্দের পাশাপাশি আপনার মনে অন্য কোনো ভাবনা কি কখনও নড়েচড়ে উঠেছে?
: উঠেছে। বারবার উঠেছে।
: যেমন?
: যেমন, ভারতের সীমানার ভেতর ঢোকার পর মনে হয়েছে_ এখানে কোনো এক স্থানে লুকিয়ে লুকিয়ে পরান বাঁচাতে বাঁচাতে শাস্তি থেকে পালাচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের মধ্যে দুই মুসলেহউদ্দিনের একজন। কানাডায় নেমে মনে হয়েছে_ এখানে এখনও অপ্রয়োজনীয়ভাবে শ্বাস নিয়ে বেড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধুর এক খুনি নূর চৌধুরী। আমেরিকার মাটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়_ এখানে বড় আরামে সময় কাটাচ্ছে জাতির জনকের আরেক খুনি রাশেদ চৌধুরী। এদের কাউকেই আমরা হাতে পাচ্ছি না, বিলম্বে হলেও, তাদের যথাপ্রাপ্য ন্যায্যভাবে বুঝিয়ে দিতে।
: কর্নেল রশীদের কথা মনে পড়ে না?
: পড়ে। বড় ঘৃণা থকথকে অবস্থায় মনে পড়ে, হতাশায় ডুবতে ডুবতে মনে পড়ে, ক্রোধের ভাটায় আংরা হতে হতে মনে পড়ে।
: লোকটা কোথায় আছে এখন? লিবিয়ায়, না পাকিস্তানে?
: জানি না কোথায় আছে। এটুকু শুধু জানি, মানবতার মূর্তিমান অপমান ও জাতির কলঙ্কাতিকলঙ্ক এই প্রাণী এখনও বড় অশ্লীলভাবে বেঁচে আছে। ওরা আমার প্রতিদিনের কাজকর্মকে বড় ডিস্টার্ব করে, আমার স্নায়ুর ওপর বড় অত্যাচার করে।
: ওদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে, দেশের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের ব্যাপারে তো ভিন্নমতও তো আছে।
: সে কেমন?
: সে এমন যে কেউ কেউ বলে_ এত বছর আবার এসব কী? সব তো আগেই চুকেবুকে গেছে! এখন আবার দেশের মানুষকে বিভক্ত করা কেন?
: আপনার এই প্রশ্নের জবাবে আমাকে একটু বিস্তৃত বলতে হবে।
: বলুন। হাতে আজ সময় আছে।
: প্রথম কথা হচ্ছে, যারা এমন বলে_ তারা আদতেই কেউ কেউ, দেশের মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় তারা কোটিতে গুটিক মাত্র। আঙুলের কড়ে গুণে তাদের ছুড়ে ফেলা যায়। ঘৃণায়, হেলায় ও অবহেলায়। তাদের আপনিও চেনেন, আমিও চিনি, দেশের সব মানুষ চেনে। এরা যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের সমান পাপী।
দ্বিতীয় হচ্ছে, কোনো কিছুই চুকেবুকে যায়নি। চুকেবুকে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে এবং সময়টা মানবতার শত্রু, স্বাধীনতার দুশমন কিছু সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক লোকের আমলে ছিল না। নষ্ট ও ভ্রষ্ট মানুষগুলোর বিচারের জন্য অনুকূল এ সময়টাকে ব্যগ্র ও কৃতজ্ঞ দু'হাতে আমাদের ধরতে হবে এবং সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে।
: সময়টার অপচয় করলে এমন ক্ষতি হবে আমাদের?
: অনেক বড় ক্ষতি হবে। সুযোগ পেলেই ওরা আবার দাপাবে, মানবতাকে আবার মাড়াবে, শুদ্ধ মানুষগুলোকে আবার ভড়কাবে, আবার তাড়াবার চেষ্টা করবে। কিছু অকৃতজ্ঞ লোক তাদের আবার পুনর্বাসন করবে, বড় নির্লজ্জভাবে আবার ওদের সামনে নিয়ে আসবে। কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক আধুনিক ও শান্তিপ্রিয় মানুষ তা হতে দিতে পারে না। এটি আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, যে ভুল আমরা একবার করেছি, তা বারবার করতে পারি না। পরের প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। গলতি বারবার করলে তা গুনাহ হয়ে যায়।
তৃতীয় কথা হচ্ছে, জাতিকে বিভক্ত করার জন্য মোটেই নয়, জাতিকে সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্যই ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের খুনি, তাদের মাস্টারমাইন্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া দরকার। কথাগুলো যতদিন আমরা বুঝতে ভুল করব, ততদিন এমন উদ্ভট, অদ্ভুত ও অযৌক্তিক প্রশ্ন এবং মন্তব্য আমাদের শুনতে হবে। এমন প্রশ্ন ও মন্তব্য আমরা আর শুনতে চাই না। প্রশ্নগুলো আমাদের শরীর খারাপ করে দেয়, মন পচিয়ে দেয়, আমাদের বড় ছোট করে রাখে। আমরা ছোটও নই, ক্ষুদ্রও নই, আমরা এসব সইতে
পারব না।

রণজিৎ বিশ্বাস :কথাসাহিত্যিক
 

No comments

Powered by Blogger.