আফগানিস্তান-লালবিবি সমাচার by শান্তনু মজুমদার

আফগান সমাজে আসন গেড়ে বসা প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়াটি লালবিবির হাত ধরে একটু হলেও সরবে কি? উত্তরাঞ্চলীয় কুন্দাজ প্রদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের পশুজীবী পশতুন যাযাবর পরিবারের অষ্টাদশী লালবিবির অদৃষ্টপূর্ব সাহসিকতার বন্দনা হচ্ছে তার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। লালবিবি, দ্বিনের হতে অধিক দ্বিন মা-বাবার মেয়ে লালবিবি।


ধর্মান্ধতার কোটরবন্দী সমাজে লালবিবির বুকে কোথা থেকে এল এই সাহস? সাহসের প্রশ্ন আসে কেন? কে এই লালবিবি? কী হয়েছে তার? কী করেছে সে?
আফগানিস্তানের বাস্তবতায় অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি লালবিবির জীবনে। গত মাসের মাঝামাঝিতে এক সকাল বেলায় জনাকয় দুর্বৃত্ত গাড়ি চালিয়ে ওদের বাড়ি আসে; অস্ত্রের মুখে হাত-মুখ বেঁধে ফেলে সবার। এবং তারা লালবিবিকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আটকে রাখে পাঁচটি দিন। এই পাঁচ দিনে লালবিবিকে হাত-পায়ের সুখ মিটিয়ে পেটানো হয়, জোর খাটিয়ে একজন আবার তাকে বিয়ে করে নেয়। তারপর অপহরণকারীরা দল বেঁধে ধর্ষণ করে লালবিবিকে। সব মিটে গেলে লালবিবিকে বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়। মেরে ফেললেই ঝামেলা সহজে চুকে যেত। কিন্তু অপহরণকারীরা তা চায়নি। তারা লালবিবিকে জ্বলজ্যান্ত এক ‘কলঙ্কস্বরূপ’ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।
আফগান সমাজ খুব সোজাসুজি পন্থায় এসব ঝামেলার সমাধান করে নেয়। ধর্ষিত কন্যাটি, ধর্ষিত স্ত্রীটি, ধর্ষিত মা-টি বিবেচিত হয় কুলের কলঙ্ক হিসেবে। প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ নারীর মধ্যেও কাজ করায় ‘কুলহারা এক কলঙ্কিনীর’ বোধ। এ অবস্থায় সবাই মিলে নারীটিকে দিয়ে আত্মহত্যা করিয়ে নেয়। অথবা নিজেরাই কষ্ট করে মেরে আত্মহত্যার একটি মোটা দাগের নাটক সাজিয়ে নেয়। প্রশাসন সাধারণত এসব এড়িয়ে যায়। কারণ, এসব ব্যাপারে মাথা ঘামালে জনগণের অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয় থাকে। এমনিতেই সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট সরকার, তার ওপর আবার উগ্রবাদে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে দেশের অনেক এলাকা। এমন অবস্থায় সরকার কেন যাবে নির্যাতিততায় আবার নারীর জীবন বাঁচাতে? আগে হচ্ছে ক্ষমতা বাঁচানো। সমাজদেহে বিদ্যমান প্রতিক্রিয়াশীলতা হটাতে আফগান রাষ্ট্র এতটুকু প্রয়াস নেয় না। লালবিবির ক্ষেত্রেও এমনটিই হওয়ার কথা। কেননা, আফগানিস্তানে লালবিবিদের এমন হওয়াটাই দস্তর। নারী সেখানে মানুষ কোনোমতেই নয়।
কিন্তু এবার যেন উল্টো কিছু একটা ঘটল। শিগগির অসীম সাহসে উঠে দাঁড়াল লালবিবি। সমাজের রক্তচক্ষু আর রাষ্ট্রিক উদাসীনতাকে বাঁ পায়ের লাথি ঝেড়ে একপাশে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটি। চিৎকার করে সে এমন এক দাবি করে বসল, যা আফগান নারী স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়। লালবিবি সুতীব্র চিৎকারে জানিয়ে দিল যে সে বিচার চায়। লালবিবি বিচার চাইছে। লালবিবির বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার চাইছে লালবিবি। সমাজ ও রাষ্ট্র প্রথমে না শোনার ভান করেছিল; ভুল শোনার ভান করেছিল। প্রলাপ ভেবেছিল। আফগান নারী বিচার চায়—হয় কখনো! কিন্তু নিশ্চুপ তারা থাকতে পারছে না চাইলেই। লালবিবি নিজের জান দিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে। তবে সমাজ যেমন করে চায়, যেমন করে হলে রাষ্ট্র বেঁচে যায়, লালবিবি তেমন করে জান দেবে না। ‘কলঙ্কিনী লালবিবি’ হয়ে জান দেবে না লালবিবি। ১৮ বছরের এই কন্যা জানিয়েছে, বিচার যদি না হয়, তাহলে প্রতিবাদস্বরূপ নিজের জান নিজে দিয়ে দেবে। এভাবেই আফগান সমাজ ও রাষ্ট্রের কদর্যমুখে কালি ঢেলে দিতে চায় লালবিবি।
মেয়ের মা-বাবাকেও দেখা যাচ্ছে ব্যতিক্রমী। লালবিবির যা হয়েছে, তেমন কিছু হলে যত দ্রুত সম্ভব মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে বিদায় করিয়ে দিয়ে বংশের মুখ রক্ষা করে পরিবার। অথচ অমানুষের সমাজে মানুষের মতো আচরণ করে উঠলেন লালবিবির মা-বাবা। তাঁর বংশ বা পরিবারের তথাকথিত ইজ্জত রক্ষার প্রয়োজনে আদরের লালবিবিকে মেরে ফেলার পথে হাঁটলেন না। বাড়ির সামনে ফেলে যাওয়া লালবিবিকে কেউ দেখার আগে মেরে না ফেলে তাঁরা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সুস্থ সমাজের মা যা করেন, বাবা যা করেন, তাঁরা তা করলেন। তাঁরা এখন তারস্বরে তাঁদের মেয়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচারের দাবি করছেন। মা-বাবা এমনকি লালবিবির দাদাও লালবিবির জান নিয়ে নেবেন বলেছেন। কিন্তু তা ‘কলঙ্কমুক্তির’ জন্য নয়। বিচার যদি না হয়, এর প্রতিবাদস্বরূপ তাঁরা লালবিবির জান নিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। লালবিবির জান লালবিবি নিজে বা তার মা-বাবা-দাদা কারোর নিয়ে নেওয়ার অধিকার নেই সত্য, কিন্তু এই ঘোষণার দিকে কান পাতলে প্রতিবাদের তীব্রতাটুকু বুঝতে পারা যায়। গত সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে কাবুলে এসে জুতার তলা ক্ষয় করছে দরিদ্র পরিবারটি। মনে আশা, যদি সরকারি কর্তাদের বিচার-প্রক্রিয়ার ব্যাপারে রাজি করা যায়। এসবের মধ্য দিয়ে পুরো পরিবারের জানের ওপরই হুমকি তৈরি হচ্ছে হয়তো।
কেন এই দুর্যোগ লালবিবির জীবনে? ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, লালবিবির জ্ঞাতি সম্পর্কের এক ভাই প্রেমে পড়েছিল অন্য এক গোত্রের এক মেয়ের। যেকোনো কারণেই হোক, নানা টানাপোড়েনের পরিণতিতে সম্পর্কটি নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাপারটিকে গোত্রের অপমান হিসেবে ধরে বসে মেয়েটির বাবা ও গোত্রের অন্যরা। আন্তগোত্র সালিসে একটি সমাধান বের করা হয়। সমাধানটিও বড় বিচিত্র। অপমানের ক্ষতিপূরণস্বরূপ লালবিবিকে তুলে দিতে হবে ‘অপমানিত’ পরিবারের হাতে! সুস্থ মস্তিষ্কে এসব ব্যাপার বোঝা দায়। কিন্তু ঘটনা সত্য। জ্ঞাতি ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা, তাতে কী? গোত্রপতিদের কথা মেনে লালবিবিকে তুলে দিতে হবে। বিকৃত এই সমাধানের নাম হচ্ছে ‘বদল’। যেকোনো কারণেই হোক, এই অসুস্থ সমাধান কার্যকর হয়নি। তখন ‘অপমানিত’ গোত্রের লোকেরা জ্ঞাতি ভাইয়ের ওপর প্রতিশোধস্বরূপ লালবিবিকে ধরে নিয়ে যায়, বিয়ে করিয়ে দেয় ও গণধর্ষণ করে। ধরে নিয়ে যাওয়া লোকেদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদী ও পুলিশ বাহিনীর লোক ছিল। এই পুলিশ আবার মার্কিন বাহিনীর হাতে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
শুরু থেকেই নানা কলাকৌশলে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে লালবিবি নির্যাতনে পুলিশের যুক্ত থাকার ব্যাপারটিই ঢেকে রাখার যেনতেন চেষ্টা হচ্ছে। এবার ব্যাপারটা একটু কঠিন হয়ে যেতে পারে। সাহসিক লালবিবির চিৎকার ইতিমধ্যে বিশ্বমানবতার কানে পৌঁছেছে। নানা জায়গা থেকে চাপ তৈরি হচ্ছে, কাবুলের ওপর মোড়ল রাষ্ট্রগুলো আফগান পুলিশের জন্য আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ডলারের যে থলেটি খোলার কথা, তার রশি কষে ধরার দাবি উঠেছে। টোকিওতে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠক থেকে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি ও জাপান মিলে আফগান পুলিশ বাহিনীর জন্য চার মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার কথা। বিছিন্ন মহল থেকে এখন এই বারাদ্দ আটকে দেওয়ার দাবি উঠেছে। লালবিবি অপহরক, লালবিবি ধর্ষক পুলিশের বিচার না হলে বিপুল অঙ্কের বরাদ্দটি আটকে দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে। এই দাবি ন্যায্য। বিশ্বমোড়লেরা লালবিবি তথা আফগান নারীর জীবন ও সম্মান রক্ষায় কী করে, দেখা যাক। তবে তারা কিছু না করলেও অসুবিধা নেই। এবার ভয় কেটে গেছে। আশা করা যায়, যাযাবর তাঁবুবাসী এক লালবিবি আফগানিস্তানে আরও অনেক অনেক লালবিবির জন্ম দেবে—ভাঙা ঘরে কিংবা দালানে। বর্তমান আফগান সমাজে সোনার চামচ মুখে কিংবা ফুটপাতে জন্ম নেওয়া নারীতে তেমন ভেদ কোথায়? আফগান নারী মানুষ নয়। লালবিবির হাত ধরে প্রতিক্রিয়াশীলতায় নিমজ্জিত আফগান পুরুষতন্ত্রে একটু হলেও ফাটল ধরাবে, এই হচ্ছে আশা।
 শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.