বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৪৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মাহফুজুর রহমান বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা মানিকগঞ্জ জেলা সদরের দক্ষিণে হরিরামপুর। এর পাশ দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহিত। ১৯৭১ সালে হরিরামপুরের সিও (সার্কেল অফিসার, এখন ইউএনও) কার্যালয়ে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প। তখন হরিরামপুরে সিও কার্যালয় ছিল বারৈখালীতে।


পাকিস্তানি ক্যাম্পে ছিল নিয়মিত সেনা, ইপিআর, ইসিএএফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স) এবং রাজাকার। সব মিলিয়ে ১০০ লোকবলের মিশ্র বাহিনী। ইপিআর বেশির ভাগ ছিল বাঙালি।
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি মাহফুজুর রহমানসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা হরিরামপুরের বারৈখালীতে আক্রমণ করেন। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে পাকিস্তানি ক্যাম্পের ইপিআরের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। এরপর লাল মিয়া নামের একজন ইপিআরের প্রতিনিধি হিসেবে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাঁদের জানান, বাঙালি ইপিআর সবাই সাহায্য করতে রাজি আছেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন আক্রমণ করবেন তখন তাঁরা পক্ষ ত্যাগ করে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন। আক্রমণেও অংশ নেবেন।
এরপর আক্রমণের তারিখ ঠিক করা হয়। দিন নির্ধারিত হয় ১৩ (কারও কারও মতে ১৬) অক্টোবর। সেদিন আনুমানিক বিকেল চারটার দিকে ওয়্যারলেস অফিস থেকে কাঠের সেতু এলাকার মধ্যে রাস্তার পূর্ব পাশে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। মাহফুজুর রহমানসহ প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের অস্ত্র ছিল খুবই সাধারণ— এসএলআর, রাইফেল ও গ্রেনেড। যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন।
ওয়্যারলেস অফিসের ছাদের ওপর ছিল পাকিস্তানিদের দুটি এলএমজি পোস্ট। এলএমজি চালনার দায়িত্বে ছিলেন দুই পাঠান সেনা। যুদ্ধ শুরু হলে আশ্চর্যজনকভাবে ওই দুই পাঠান সেনা তাঁদের এলএমজি দিয়ে গুলি করা থেকে বিরত থাকেন। পরে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণও করেন। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ সুবিধা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধের একপর্যায়ে ওয়্যারলেস স্টেশনে থাকা পাকিস্তানিরা সিও অফিসের মূল ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। তখন মাহফুজুর রহমানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ওয়্যারলেস অফিসে আগুন লাগাতে যান। আগুন লাগানোর সময় পাকিস্তানিরা তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়। তখন গুলিবিদ্ধ হন মাহফুজুর রহমান ও বজলুর হুদা ওরফে পান্নু। তাঁরা দুজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
সহযোদ্ধারা তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করে আনেন। মাহফুজুর রহমান গুরুতর আহত হয়েছিলেন। চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। বজলুর হুদা বেঁচে যান।
মাহফুজুর রহমান ১৯৭১ সালে জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কর্মরত ছিলেন। শ্রমিক রাজনীতিও করতেন। মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সেখানে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে যুদ্ধ করেন তিন নম্বর সেক্টরে। পরে নিজ এলাকা মানিকগঞ্জে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মাহফুজুর রহমানকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৪৬। তাঁর প্রকৃত নাম মাহফুজুর রহমান খান।
শহীদ মাহফুজুর রহমান খানের পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার পিপুলিয়া গ্রামে। তবে তাঁর বাবা-মা ঢাকায় বসবাস করতেন। বাবা-মার একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলেন। তাঁর বাবার নাম জিয়ারুল হক খান। মা শামছুন্নাহার ওরফে ফিরোজা বেগম।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.