ওষুধের দাম বাড়ছেই by শিশির মোড়ল

ওষুধের দাম বাড়ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো বাড়তি লাভের জন্য ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। ওষুধের বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা সরকার নিজের হাতে ফিরিয়ে নিলেই মানুষ কম দামে ওষুধ পাবে।


সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি বলছে, গত ছয় মাসে এক হাজার ২০০টির বেশি ওষুধের দাম বেড়েছে। ওষুধ ভেদে দাম ২০ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়েছে।
রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা ওষুধের বাজার, বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ওষুধ শিল্প সমিতি এবং নিয়মিত ওষুধ ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগের ওষুধ ছাড়াও আরও অনেক ধরনের ওষুধের দাম একসঙ্গে বেড়েছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, সাম্প্রতিক কালে দাম বেড়েছে এমন তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশি মানুষের দরকার হয় এমন ওষুধের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এই ওষুধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দাম বাড়লে ওষুধের প্রাপ্যতা কমে। পরিস্থিতির শিকার হয় দরিদ্র মানুষ।’
রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা নেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী অনিল বিশ্বাস। গত ২০ মে ওই হাসপাতাল এক সপ্তাহের ওষুধের একটি তালিকা দিয়েছে তাঁকে। ছয়টি ওষুধ কিনতে তাঁর খরচ হয়েছে ৭১৬ টাকা। মাস তিনেক আগেও একই ওষুধ কিনতে তাঁর ১০০ টাকা কম লাগত। প্রতি সপ্তাহে ওষুধের খরচ জোগাতে অনিলের এখন দিশেহারা অবস্থা।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ওষুধের দাম বেড়েছে।
প্রথম সারির কোম্পানিগুলোর মধ্যে শুধু এসকেএফ এই সময়ে কোনো ওষুধের দাম বাড়ায়নি। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক মীর মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাড়তি লাভ করতে চাইনি বলে দাম বাড়াইনি।’
কোন ওষুধের দাম বেড়েছে: উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কার্ডিপিন (৫০ এমজি), অ্যামলোটেন (৫০ এমজি), ক্যামালডিন (৫০ এমজি) এসব ওষুধ দুই মাস আগেও একটি বড়ি চার টাকা দামে বিক্রি করতেন খুচরা বিক্রেতারা, এখন ছয় টাকা। অর্থাৎ এসব ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
উচ্চ রক্তচাপের অন্য ওষুধ আলফাপ্রেস-১ ও আলফাপ্রেস-২-এর প্রতিটি বড়ির দাম ছিল যথাক্রমে ৩ ও ৫ টাকা। এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৪ ও ৬ টাকা।
বেড়েছে পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের দামও। দুই বছর আগে অ্যান্টাসিডের দাম ছিল ৫০ পয়সা। এখন এক টাকা। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশ।
সেকলো, জেলরিন, প্রোসেপ্টিন, কোসেক, ম্যাক্সপ্রো—গ্যাস্ট্রিকের এসব ওষুধের একটি বড়ির দাম দুই মাস আগেও ছিল চার টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে পাঁচ টাকা করে। এসব ওষুধের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
ব্যথানাশক ফ্লেক্সি (১০০ এমজি) ও এপিটাল (১০০ এমজি) প্রতি বড়ি তিন টাকা করে বিক্রি করতেন খুচরা বিক্রেতারা, এখন চার টাকা। দুই মাসে ওষুধটির দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। বিভিন্ন রোগে ব্যবহার করা কয়েক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের দামও বেড়েছে।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ইনসেপ্টার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির জানান, টাকার মূল্যমানের বিবেচনায় ওষুধের দাম বাড়েনি। ’৯০ সালে রেনিটিডিন বড়ি বিক্রি হতো দুই টাকা করে। এত বছর পর তা বিক্রি হচ্ছে আড়াই টাকায়। এই সময়ে তেল, গ্যাস, পানিসহ অন্য যেকোনো পণ্যের দাম কী পরিমাণ বেড়েছে, তা ভাবতে হবে।
দাম বাড়ার যৌক্তিকতা: সম্প্রতি স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপ্টাসহ প্রথম সারির প্রায় সব কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ওষুধের খুচরা বিক্রেতারা জানান, তিন-চার মাস হলো, একসঙ্গে বেশ কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। আবদুল মুক্তাদির জানান, ছয়-সাত মাস হলো ওষুধের দাম বেড়েছে।
স্কয়ার সেকলো বড়ির (গ্যাস্ট্রিকের) দাম ২৫ শতাংশ এবং ক্যামলোডিন বড়ির (উচ্চ রক্তচাপের) দাম ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। এর যৌক্তিকতা জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন) মোহাম্মদুল হক বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমেছে। একই পরিমাণ কাঁচামাল আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। এতে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
আবদুল মুক্তাদির জানান, গত কয়েক বছরে চাল, ডাল, বিদ্যুৎ, গ্যাস—সবকিছুরই দাম বেড়েছে, বাড়েনি শুধু ওষুধের। বরং টাকার মূল্যমান বিবেচনা করলে দেখা যাবে, দাম কমেছে।
তবে মীর মোস্তাফিজুর রহমানসহ এসকেএফের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওষুধের কাঁচামালের দাম বাড়া বা কমা নৈমিত্তিক ঘটনা। ওষুধের দাম বাড়ার প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া। এসকেএফ মনে করে, টাকার মান আবার বাড়বে। তাই ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও সাইদুর রহমান জানান, কোম্পানিগুলো যেসব ওষুধের দাম বাড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিক কালে সেসব ওষুধের কাঁচামালের দাম বাড়েনি। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কাঁচামালের দাম কমলেও কোম্পানিগুলো কিন্তু তখন ওষুধের দাম কমায় না।
ওষুধ আর চাল-ডাল এক নয়: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল ওষুধ উৎপাদন খরচ ছোট-বড় সব কোম্পানির প্রায় সমান। সিপ্রোফ্লক্সাসিন ৫০০ এমজি বড়ি বেশ কয়েকটি কোম্পানি তৈরি করে। সিপ্রোসিন, ফ্লোক্সাবিড, সিপ্রো-এ, ফ্লক্সি, নিওফ্লোক্সিন, কুইনোক্স ইত্যাদি নামে বাজারে বিক্রি হয়। এক কোম্পানির বড়ি অন্য কোম্পানির চেয়ে ভালো এমন কোনো যুক্তি বা তথ্য কারও হাতে নেই, কেউ তা দাবিও করে না। অথচ দেখা যাচ্ছে, এক কোম্পানির একটি বড়ির দাম ১৪ টাকা, অন্য কোম্পানির বড়ির দাম সাত টাকা।
কাঁচামাল ভারত ও ইউরোপ থেকে আনলে সে ক্ষেত্রে দামের কিছু পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু এত পার্থক্য কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে স্কয়ার, ইনসেপ্টা, এসকেএফ—এই তিনটি কোম্পানিরই কর্তাব্যক্তিরা দাবি করেছেন তাঁদের বড় স্থাপনা, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনশক্তির জন্য বিনিয়োগ বেশি। তাই উৎপাদন খরচও বেশি।
সাইদুর রহমান জানান, ওষুধ আর চাল, ডাল একই ধরনের পণ্য নয়। স্বল্পমূল্যে ওষুধ পাওয়া মানুষের স্বাস্থ্য অধিকারের মধ্যে পড়ে। বিনিয়োগের দোহাই দিয়ে ওষুধের মূল্য বেশি ধরা অনৈতিক।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও সাইদুর রহমান জানান, এক দশকের বেশি সময় ধরে কোম্পানিগুলো দামি মোড়ক, বিপণন এবং ‘অনৈতিক প্রচার’ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ওষুধের নাম যেন ব্যবস্থাপত্রে লেখেন, সে জন্য চিকিৎসকদের কোম্পানিগুলো নানা উপঢৌকন দেয়, খুচরা বিক্রেতাকে বাড়তি কমিশন দেয়—এগুলোকে এ দুজন ‘অনৈতিক প্রচার’ খাত বলছেন। এই খাতের ব্যয়কেও কোম্পানিগুলো ওষুধের দামের সঙ্গে যুক্ত করছে। এতে লাভবান হচ্ছে কোম্পানি, চিকিৎসক ও ওষুধের দোকানদার। আর বেশি দামে ওষুধ কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
তিনটি ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওষুধের স্বার্থেই ভালো মোড়ক ব্যবহার করা হয়। এটি বিপণন ব্যবসারই অংশ। তবে তারা কেউই ‘অনৈতিক প্রচার’ করে না বা এর জন্য বাড়তি ব্যয় করে না।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সরকার: বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক এ এস এম মনির হোসেন বলেন, ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো ভূমিকা না থাকায় ওষুধের দাম বাড়ছে। ১৯৯৪ সালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি অফিস নির্দেশনার ফলে সরকার নিজেই ওষুধের দাম নির্ধারণে নিজের ভূমিকা রাখার ক্ষমতা হারিয়েছে।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বিএনপি সরকারের সময় ’৯৪-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাবহির্ভূত ওষুধের দাম নিজ নিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। ’৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে যেকোনো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের ছিল।
এ প্রসঙ্গে জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, বিএনপি সরকার ’৯৪ সালে ভুল করেছিল। দেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে ওষুধ ব্যবসায়ীদের পক্ষে একটি নির্দেশ জারি করে। বর্তমান সরকারের উচিত বিএনপির গণবিরোধী অফিস আদেশটি বাতিল করা। মনির হোসেন ও সাইদুর রহমানও ’৯৪ সালের আদেশটি বাতিলের পক্ষে।
ওই আদেশের পর থেকে কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম ঠিক করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানায়। ওই দাম নির্ধারণ করার যুক্তিও তারা তুলে ধরে। ১৮ বছর ধরে কোম্পানিগুলো যে দাম চাইছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সেই দামেই বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। সাইদুর রহমানের প্রশ্ন, গত ১৮ বছরে একটি ওষুধের দামও প্রশাসনের কাছে অযৌক্তিক মনে হয়নি?
আবদুল মুক্তাদির, মীর মোস্তাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদুল হক জানিয়েছেন, ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলে বাজার সংকুচিত হবে, মানুষকে আরও বেশি দামে ওষুধ কিনতে হবে। আদেশটি বাতিল হোক, তা তাঁরা চান না।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যসচিব মো. হুমায়ুন কবির জানান, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকার ওষুধ কেউ উৎপাদন করলে সরকার তার দাম নির্ধারণ করে দেয়। তালিকার বাইরের ওষুধের ক্ষেত্রে সরকার তা পারে না। ’৯৪ সালের অফিস আদেশের ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বেহাল তালিকা: প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের একটি তালিকা আছে। সময়ভেদে এই তালিকায় ওষুধের পরিবর্তন হয়। ওই তালিকাকে ভিত্তি ধরে বিভিন্ন দেশ ভৌগোলিক অবস্থান ও রোগের প্রাদুর্ভাব বিবেচনায় নিয়ে নিজের জন্য আলাদা তালিকা তৈরি করে।
বাংলাদেশের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় আছে ১১৭টি ওষুধ। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি এই ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার-নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে ওষুধ বিক্রি করতে পারে না। উদাহরণ প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। ছোট বড় সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের দাম ৮০ পয়সা।
’৯৪ সালের অফিস আদেশে বলা ছিল, ‘প্রত্যেক উৎপাদনকারীকে অন্ততপক্ষে ৬০% তালিকাভুক্ত ঔষধ প্রস্তুত করিতে হইবে।’ মনির হোসেন জানান, কোম্পানিগুলো ওই নির্দেশনা অমান্য করে চলেছে। নিজেদের ওষুধের দাম নিজেরা ঠিক করছে, কিন্তু অনেকেই তালিকার ৬০ শতাংশ ওষুধ তৈরি করছে না।
এ ব্যাপারে আবদুল মুক্তাদির জানান, সরকার-নির্ধারিত মূল্যে ওষুধ বিক্রি করলে কোম্পানিগুলোর লাভ হয় না।
মোহাম্মদুল হক জানান, প্রতিটি প্যারাসিটামল (স্কয়ার এই ওষুধ এইস নামে বাজারজাত করে) বড়ির পেছনে খরচ হয় ৮০ পয়সার বেশি। কিন্তু লোকসান দিয়ে তা বিক্রি করতে হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.