বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি by অধ্যাপক আবুল বারকাত

আর দেশজ বিনিয়োগ অনুৎসাহিত হলে বিদেশী বিনিয়োগ অধিকতর অনুৎসাহিত হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগহীন এক অর্থনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হবে যখন ভেঙ্গে পড়বে সমগ্র অর্থনীতি-ব্যবস্থা। আর এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি করতে পারলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল অসম্ভব নয়।


ছক ২ : মৌলবাদী শক্তিসমূহের কৌশলিক আন্তঃসম্পর্ক
‘ইসলাম’ নামাঙ্কিত মূল ধারার রাজনৈতিক দল
(প্রকাশ্য সংগঠন)
মনে রাখা জরুরী যে, বাংলাদেশে মৌলবাদী জঙ্গীরা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রু। এ শত্রুদের প্রতিশোধস্পৃহা ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারা ধর্মের নামে নির্বিচারে মানুষ খুন করেছে ও করবে। উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী এ জঙ্গীরা ধর্মের নামে জোরজবরদস্তি করে রাষ্ট্রক্ষমতাটিকেই দখল করতে চায়। সাম্প্রদায়িক জঙ্গীবাদ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে চলেছে। ওদের জঙ্গিত্ব ক্রমান্বয়ে অতীতের সকল সীমা অতিক্রম করছেÑ প্রথমে নিরীহ বেশে ধর্মের বাণী, তারপরে শরীর চর্চার নামে একটু-আধটু প্রশিক্ষণ, তারপরে পটকার খেলা, তারপরে স্পিলিন্টার ছাড়া বোমা, তারপর পিস্তল-রিভলভারের খেলা-প্রদর্শন, তারপর সভাস্থলসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বোমা মেরে মানুষ হত্যার মাধ্যমে বাঙালীর সংস্কৃতি হত্যার প্রয়াস, তারপর বাঙালী জাতিকে রাজনীতিবিদ শূন্য করার প্রচেষ্টা, তারপর এক সাথে একই সময়ে দেশের সব জেলা শহরের সরকারি অফিস ও বিচারালয়ে বোমা, তারপর বিচারক হত্যা, আর সবশেষে সুইসাইড বোমা। সাম্প্রদায়িক জঙ্গিত্বের ক্রমধারা যা তাতে স্পষ্ট যে ওরা যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং সুইসাইড বোমাই শেষ কথা নয়। যদি নিরস্ত্র করা না যায় তাহলে সামনে সম্ভবত আরো বড় মাপের নতুন ধরনের বিপর্যয় ঘটবে যা হয়তো বা এ মুহূর্তে কল্পনাও করা যাচ্ছে না। বাঙালী জাতির ইতিহাসে এ কোনো সাধারণ সংকট নয়Ñ প্রকৃত অর্থেই মহা-বিপর্যয়; গভীর সংকটের এ এক ক্রান্তিকাল।
মহা-সংকটটি এমনি যে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ধর্মান্ধ রাজনীতিকরা অনেক গুরুতর ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা প্রকাশ্যেই বলেছেন। এখনও বলছেন। যেমন তারা বলেন :
১. “১৯৭১ আর ২০০৫ সাল এক কথা নয়।”
২. “আমরা কচুপাতার ওপর বৃষ্টির পানি নই যে টোকা দিলেই পড়ে যাবো।”
৩. “কোথায় আজ ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, আর আমরা আজ কোথায়” (?)
৪. “সংসদের কয়েকটি আসন দিয়ে আমাদের শক্তির বিচার করলে ভুল করবেন।”
৫. “শীঘ্রই ইসলামী শাসন কায়েম হবে। দেখুন-অপেক্ষা করুন; পরবর্তী নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকুন।”
৬. “ইসলামে আত্মহত্যা পাপ তবে ইসলামী শাসন/হুকুমত কায়েম হয়ে গেলে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
৭. “জ্ঞানপাপী মানুষ প্রণীত সংবিধানের পরিবর্তে আল্লাহ্র বিধান কার্যকরী করতে সশস্ত্র জেহাদের মাধ্যমে দেশে যতদিন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন না হয় ততদিন তাগুতের বিচারালয়ে যাওয়া বন্ধ রাখুন।”
৮. “সশস্ত্র জেহাদ করা আমার অধিকার, আর ঐ জেহাদে অংশগ্রহণ আমার দায়িত্ব। আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই।”
ইসলামী জঙ্গিত্ব-উদ্ভূত মহাসংকটের গভীরতা এখানেও যে ইতোমধ্যে ধৃত জঙ্গীদের প্রায় সবাই দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান; এদের মধ্যে যারা স্বাক্ষর করেছে তাদের প্রায় সবাই মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে এসেছেন; এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন অথবা আছেন। আরো দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে এখন পর্যন্ত ধৃত ২০০০ জঙ্গীদের গড় বয়স মাত্র ২২ বছর (১৬ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে)। অথচ ১৫-২০ বছর আগে গণমাধ্যমে জঙ্গী প্রশিক্ষণের যেসব সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছিল অথবা ১০-২০ বছর আগে যারা আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বার্মাতে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের বয়স তো এখন হবে ৪৫-৫৫ বছরÑ তারা কোথায়? আর যারা ১৯৭১-এ আল বদর-আল শামস-রাজাকার-শান্তি কমিটির নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন এবং/অথবা মুখ্য পরামর্শদাতার কাজ করেছিলেন তাদের বয়স তো এখন ৬০-৮৫ বছরের মধ্যেÑ তারা কোথায়? এসব গডফাদারদের বড় অংশই ১৯৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ করেছেন। এসব গডফাদারকে অনেকেই এখনও বহাল তবিয়তে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করারও এ এক নবতর কৌশল হতে পারে। মহাবিপর্যয়টি এখানেও।
সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতি কোনো দুর্বল প্রতিপক্ষ নয় এ জন্যেও যে তারা ইসলামের মুলমন্ত্র পরিত্যাগ করে “অর্থনৈতিক ক্ষমতাভিত্তিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া”-কে (বপড়হড়সরপ ঢ়ড়বিৎ নধংবফ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ঢ়ৎড়পবংং) রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এ কৌশল আসলে ধর্মের ‘সুঃযড়ং’-এর সঙ্গে বাস্তবের ‘ষড়মড়ং’-এর সম্মিলনের এক আধুনিক পদ্ধতি মাত্র (খোমেনি পদ্ধতি)। এ পদ্ধতিতে ধর্মকে “রাজনৈতিক মতাদর্শে” রূপান্তর করা হচ্ছে। ধর্মভিত্তিক এ রাজনৈতিক মতাদর্শ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। (চলবে)

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
(লেখাটি ২৬ জুন জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা ২০১২-এ পঠিত)

No comments

Powered by Blogger.