গহন গহীন-পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কে নতুন মোড় by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

দুই দেশের মধ্যে সাত মাসের রুদ্ধশ্বাস 'শাটল ডিপ্লোম্যাসি' শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হলো। রুদ্ধ দুয়ার খুলে গেল- আয়তন, প্রভাব, বিত্তবৈভব ও ক্ষমতার নিরিখে বিচার করলে দুই দেশের মধ্যে কোনো তুলনাই হয় না। একটি দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বের একমাত্র ক্ষমতাধর শক্তি, যার দাপটে সারা পৃথিবী কম্পমান।


আর অন্য দেশটি পাকিস্তান, যে দেশ নিজ সমস্যায় বিব্রত, বিশ্ব পরিমণ্ডলে অনিরাপদ, সন্ত্রাসকবলিত এই দেশটিতে জঙ্গি হামলা, বোমার বিস্ফোরণ, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বিরক্তিকর পৌনঃপুনিকতায় সংঘটিত হচ্ছে। সম্প্রতি দেশটিতে নতুনভাবে সংকটের মাত্রা বেড়েছে বিচার বিভাগের অভূতপূর্ব রায়ের ফলে। উচ্চ আদালতের সঙ্গে সংঘাতের ফলে নির্বাচিত সরকারের এখন টলটলায়মান অবস্থা। বলা হয়, সব সমস্যার প্রধান কারণ দেশটির 'সিল মারা' দুর্নীতিপরায়ণ প্রেসিডেন্ট 'মিস্টার টেন পারসেন্ট' নামে দেশ-বিদেশে যার ব্যাপক পরিচিতি!
এ রকম সমস্যা-জর্জরিত দেশ পাকিস্তান আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতিশয় প্রয়োজনীয় মিত্র- তার ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব আর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী বিদেশ-নীতির অপরিণামদর্শিতার কারণে।
যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষমতার প্রভাববলয় বৃদ্ধি করার জন্য দেড় দশক ধরে বিভিন্ন দেশে সেনা পাঠিয়েছে। এই একদা প্রয়োজনীয় বিবেচিত আগ্রাসী মনোভাবের কারণে দেশটি আজ নানা সমস্যায় বিশ্বব্যাপী নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলছে। বুশ প্রশাসনের 'বাজপাখি' নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিপন্ন। দেশের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ। এখন নীতিনির্ধারকদের প্রধান এবং একমাত্র বিবেচ্য এসব নিজের সৃষ্টি 'চোরাবালি পরিস্থিতি' থেকে বের হয়ে আসা। বিদেশে যুদ্ধ লড়তে গিয়ে কম তো মূল্য দিতে হচ্ছে না দেশটিকে। কিন্তু এর ফলাফল যে শূন্য তা বোধ হয় এখন মোটামুটি স্পষ্ট।
তাই দেশটির নীতিনির্ধারকরা বিদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে আনার কর্মসূচি নিয়ে এখন কাজ করছেন এবং এর পুরো ফল আদায় করে নিল পাকিস্তান তার সাম্প্রতিক 'কূটনৈতিক বিজয়ের' মধ্য দিয়ে। সাত মাস বন্ধ থাকার পর খুলে গেছে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে ন্যাটো ও মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য রসদবাহী যানবাহনের চলাচলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, যা আরোপ করা হয়েছিল ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে। ন্যাটো-মার্কিন যৌথ কমান্ডের একটি ১৫০ সদস্যের সেনাদল পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে আক্রমণের শিকার হয়ে বিমানবাহিনীর সমর্থন চায়। বিমান আক্রমণের শিকার হয় পাকিস্তানের দুটি সীমান্ত সেনাচৌকি, নিহত হন ২৪ জন সেনা সদস্য। 'বন্ধুর আক্রমণে' (ফ্রেন্ডলি ফায়ার) একসঙ্গে এত জন সেনাসদস্যের মৃত্যুর ঘটনা অকল্পনীয়। প্রতিক্রিয়া হলো তাৎক্ষণিক। দুই দেশের মধ্যে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে পড়ার উপক্রম।
পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করল সেনাসদস্যদের 'ঠাণ্ডা মাথায় খুন' করার অভিযোগে। পেন্টাগন পাল্টা অভিযোগ করে বলল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তরফ থেকে প্রথম আক্রমণ করা হয় যৌথ সেনা কমান্ডের ওপর। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান অনড় অবস্থান নিয়ে যৌথ কমান্ডকে অভিযুক্ত করে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে অবস্থানরত ন্যাটো-মার্কিন বাহিনীর জন্য রসদ পরিবহনের পথ বন্ধ করেছিল। এই সাপ্লাই রুট আফগানিস্তানে অবস্থানকারী মিত্র বাহিনীর 'জীবন-রেখা' (লাইফ লাইন)। শর্ত আরোপ করেছিল সাপ্লাই রুট ফের খুলে দেওয়ার জন্য। ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের কর্মসূচি। ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সেনাসামন্ত প্রত্যাহার করা হবে সম্পূর্ণভাবে। ২০১৩ সালে শুরু হবে আফগান সেনাবাহিনীর হাতে দেশের প্রতিরক্ষার দায়দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া। সাড়ে তিন লাখ আফগান সেনাসদস্যকে দেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য সার্বিকভাবে ইতিমধ্যে প্রস্তুত করে তোলা হবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অতীতে এমন সংকটে আর কখনো পড়েনি। দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট প্রথম প্রকাশ পায় ২০১১ সালের ১ মে, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগোচরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও সিআইএ যৌথ অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে লুকিয়ে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর শত্রু ওসামা বিন লাদেনকে হাওয়াই হামলায় হত্যা করে। ওসামা বিন লাদেনের ওপর এই অতর্কিত ও অগোচরে হামলার ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অহংবোধ ভীষণভাবে আহত হয়। একদা আত্মম্ভরি সেনাবাহিনীর প্রথম বিপর্যয় পাকিস্তানিরা প্রথম লক্ষ করে বাংলাদেশে চরম পরাজয়ের মধ্যে। 'নিজের দেশ সার্থকভাবে কয়েকবার জয়ের কৃতিত্বে' স্ফীত সেনাবাহিনীর ইগো দ্বিতীয় ধাক্কা খায় লাদেনের হত্যাকাণ্ডে। আর এবার সেনাসদস্যদের মৃত্যুতে তার যেন পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। সেনাবাহিনী টের পেল না, মার্কিনরা সফলভাবে অপারেশন করে বিন লাদেনকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে সটকে পড়ল! যদিও অকুস্থল অ্যাবোটাবাদের শক্তিশালী সেনাছাউনি (ক্যান্টনমেন্ট) থেকে অদূরেই বাস করতেন লাদেন! কোনো ব্যাখ্যাই পাকিস্তানিদের সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। সেনাবাহিনী তার নিজের সদস্যকে রক্ষা করতে পারল না হাওয়াই হামলা থেকে!
পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে মাল চলাচল করার সুযোগবঞ্চিত যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো বাহিনীর পক্ষে বর্তমানে কোনোমতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও সেনা প্রত্যাহারের কাজটি হবে প্রায় অসম্ভব। বিকল্প পথ হিসেবে 'উত্তরের স্থলপথ' নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা, হিসাব-নিকাশ করেও কূলকিনারা করতে পারেনি ন্যাটো কমান্ড।
'স্থলাবদ্ধ' আফগানিস্তানে প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের সহজ পথটি পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে। যদি বিকল্প পথ ব্যবহার করতে হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল এবং বিপদসংকুল। মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার মধ্য দিয়ে এই দীর্ঘ পথ ব্যবহার করলে অতিরিক্ত সময় ব্যয় তো হবেই, খরচও বেড়ে যাবে আড়াই গুণ। অথচ পাকিস্তানের রুট ব্যবহার করলে ট্রাকপ্রতি গুনতে হয় মাত্র ২০০ ডলার। যুক্তরাষ্ট্র এই অতিরিক্ত ব্যয় বহনে সক্ষম হলেও ন্যাটোর অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো বেঁকে বসল। চাপ দিল যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে।
এদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে জঙ্গি ও তালেবানদের সংশ্লিষ্টতার কথা পেন্টাগন প্রকাশ্যে বলে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সরবরাহ পথ বেশিদিন বন্ধ থাকা যে ওয়াশিংটনের আফগান অভিযানের স্বার্থবিরোধী তা স্বীকার করে ইসলামাবাদের সঙ্গে মিটমাট করতে ওয়াশিংটন নানা রকম তৎপরতা প্রকাশ্যে ও গোপনে অব্যাহত রাখে। কিন্তু কিছুতেই মার্কিন ভোটারদের কাছে এমন বার্তা যেন না যায়, যাতে মনে হতে পারে বর্তমান মার্কিন প্রশাসন দুর্বল এবং ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা জাতীয় অহংবোধকে আহত করেছে, সেই ব্যাপারে অতিশয় সচেতন ছিল হোয়াইট হাউস। সর্বশেষ ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে আটলান্টিকের ওপর যখন তাঁর বিমান, তখন নাটকীয়ভাবে উল্টোপথ ধরলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। তিনি যাচ্ছিলেন পাকিস্তানে। সেখানে তাঁর ঘোষণা করার জন্য প্রস্তুতকৃত বক্তব্যটি ছিল : 'চেয়ারম্যান ডেম্পসি (জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি, চেয়ারম্যান, জেনারেল চিফ অব স্টাফ) জেনারেল কায়ানিকে (পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি) অবহিত করেছেন যে আমরা এই বিয়োগান্তক দুর্ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।'
বিমানে তাঁর কাছে জরুরি বার্তা গেল : 'ক্ষমা প্রার্থনা করা হচ্ছে না'।
হোয়াইট হাউসে নীতিনির্ধারকরা শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, একই সঙ্গে সেনা কর্তৃপক্ষ ও হোয়াইট হাউসের ক্ষমা প্রার্থনা ওবামা প্রশাসনের জন্য বিরাট বোঝা হবে।
এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম তৎপরতা চললেও বিশেষ ফল লাভ হলো না। যদিও সীমান্তে হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্রমাবনতি ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের উদ্বিগ্ন করে। যুক্তরাষ্ট্রের 'সন্ত্রাসবিরোধী' অভিযানে পাকিস্তানকে মিত্র হিসেবে পাওয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের অপরিহার্য অংশ বলে মনে করেন স্ট্র্যাটেজিস্টরা।
এরপর ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত শেরি রহমানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের যোগাযোগের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। শেরি রহমান স্টেট ডিপার্টমেন্টকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন সেনাসদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া ইসলামাবাদের কাছে আর কোনো মার্কিন পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না।
এরপর ঘটল এক নাটকীয় ঘটনা, যাকে অভিহিত করা হলো : 'বার-বি-কিউতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমা প্রার্থনার নাটক।'
৩ জুলাই সন্ধ্যা রাতে শেরি রহমানের ওয়াশিংটনের বাসভবনের পেছনের আঙিনায় আয়োজিত বার-বি-কিউ পার্টিতে আচমকা হাজির হলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা টন ডনিলন সশরীরে হাজির হয়ে রাষ্ট্রদূতকে জানালেন, 'পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে জীবনহানি ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখিত।'
দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলল। সফল দূতিয়ালির পর খুলে গেল পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে ন্যাটো-মার্কিন সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহের রাস্তা। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ওপর এ ঘটনা ইতিবাচক ফলাফল আনবে, পর্যবেক্ষকদের ধারণা তেমনই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক

No comments

Powered by Blogger.