সমাজ-সুনাগরিক হতে সুশিক্ষা প্রয়োজন by হামিদুল হক

যে ছেলেটি মফস্বল থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ঢাকার গাড়ি চলাচলে ব্যস্ত রাস্তা পারাপারে ভয় পেত, সে ছেলেটি অল্প কয় দিনে কী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে! অস্ত্র হাতে দৌড়াচ্ছে! রাজনীতি তো কারণ বটেই। অথচ এসব শিক্ষার্থী পরিবার যদি তাদের সৎ জীবনযাপন ও উন্নত মূল্যবোধ লালনের শিক্ষা দিত তাহলে কি তারা এতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারত!


২০০৯ সালের এপ্রিল। তখন দুই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ভাইস চ্যান্সেলর মনে রাখার মতো দুটি উক্তি করেছিলেন। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে ওপর মহলের তদবিরে নিয়মবহির্ভূতভাবে ছাত্রভর্তি বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, 'যারা আমাকে এখানে বসিয়েছে, তাদের অনুরোধ কি রাখতে পারব না?' জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ সম্পর্কে সেখানকার ভিসির অপর একটি মন্তব্যও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। অথচ ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপ এ জন্য পরস্পরকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছিল। জাবির পরিস্থিতি তখন এতটাই নাজুক হয়ে উঠেছিল যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এতে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। দুই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদ্বয়ের মন্তব্য শিক্ষাবিদের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী, এমনকি শিক্ষিকাদের সঙ্গে কতিপয় ছাত্র ও শিক্ষকের অশালীন আচরণ মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পারি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অশালীন আচরণের ইতিহাস অনেক পুরনো। অভিযুক্তদের মধ্যে যেমন ছিল ছাত্র; অভিযোগের তীর ছিল দু'একজন শিক্ষকের প্রতিও। হাইকোর্ট এ বিষয়ে রুলও দিয়েছিলেন। কোনো প্রতিকার হয়েছে কি? অতি সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী অধ্যাপক স্ত্রী ও সন্তান রেখে এক ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন বলে অভিযোগ এনেছেন ওই শিক্ষকের স্ত্রী। অবশ্য এর সঙ্গে যৌতুক ও নির্যাতনের অভিযোগও আছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের বিকৃতির প্রকাশ অবশ্যই নিন্দনীয়। এটা অভিভাবকদের অবশ্যই তাদের কন্যাসন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হয়। ছাত্রীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ ও যৌন হয়রানির মতো ঘটনা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত নারীকে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদায় আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি বলেই পরিবারের চৌহদ্দিতে যেমন, তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তার কমবেশি নিগ্রহের শিকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেহেতু সুনাগরিক গড়ার আধার, তাই এসব জায়গায় নারীর প্রতি অসম্মানকে খাটো করে দেখা যায় না।
তবে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও দায়িত্ব কম নয়। ইউরোপে দেখেছি, স্কুলে সন্তানের আচরণ বা পড়ালেখা খারাপ হলে পিতা-মাতাকে ডেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কাউন্সেলিং করে। ছেলেমেয়ে বখাটে বা খারাপ হলে পুলিশ পিতা-মাতা ও পরিবারের খোঁজখবর আগে নেয়_ সন্তান কি তার পরিবারের লালনপালনের অনুপযুক্ততায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে? সেটা কি জেনেটিক কারণে বা মানসিক কারণে বা পরিবেশের কারণে? সন্তান পালনে পরিবার উপযুক্ত না হলে সে সন্তানটির রাষ্ট্র দায়িত্ব নেয়।
বাংলাদেশে অস্ত্র নিয়ে মারপিট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররা। মেধাবী বলতেই হবে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে তো সাধারণ মেধার ছাত্ররা ভর্তি হতে পারে না। তাদের পিতা-মাতার কি কোনো দায়িত্ব নেই? যে ছেলেটি মফস্বল থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ঢাকার গাড়ি চলাচলে ব্যস্ত রাস্তা পারাপারে ভয় পেত, সে ছেলেটি অল্প কয় দিনে কী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে! অস্ত্র হাতে দৌড়াচ্ছে! রাজনীতি তো কারণ বটেই। অথচ এসব শিক্ষার্থী পরিবার যদি তাদের সৎ জীবনযাপন ও উন্নত মূল্যবোধ লালনের শিক্ষা দিত তাহলে কি তারা এতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারত! চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ভূমিকাও যুক্ত।
আরেকটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না বলে পারছি না। আমি তখন ঢাকা জজকোর্টে প্র্যাকটিস করি। আমার এক সহকর্মী করিতকর্মা মুহুরি থাকা সত্ত্বেও একজন তরুণ অর্ডারলি নিয়োগ করেন। ছেলেটি বেশ সুদর্শন ও বিনয়ী। ওর কাজ ছিল আমার উকিল সহকর্মীর ফাইলপত্র বহন করা। কিছুদিন পর দেখি সে কালো কোট পরে কোর্টে আসছে। আমি বিস্মিত হয়ে আমার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করি, তার অর্ডারলির কি বারে এনরোলমেন্ট হয়েছে? সহকর্মী উত্তরে বললেন, না না। তার কী করে বারে এনরোলমেন্ট হবে! ল' পড়া তো দূরের কথা, সে বিএ-ও পাস করেনি। কালো কোট পরে আদালতে আসে কালো কোটের সুবিধা পাবে বলে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আমার সহকর্মী ছেলেটিকে বিদায় করে দেন। চার-পাঁচ মাস আগে বসুন্ধরায় আমার ছেলেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পেঁৗছে দিয়ে দুরারোগ্যে আক্রান্ত আমার এক সিনিয়র সহকর্মীকে দেখতে অ্যাপোলো হাসপাতালে যাই। হঠাৎ সেখানে ওই ছেলেটির সঙ্গে দেখা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী করছ এখন? ছেলেটি জানাল, সে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছে। আমি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালাম। সে তো এইচএসসি পাস। আমার প্রশ্নবোধক মুখ দেখে বলল, না, আমি ওদের নাট্যকলা বিভাগে আছি। আবারও অবাক হলাম। আমি জানি, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা-সঙ্গীত অনুষদ নেই। আমি জিজ্ঞেস করলে সে বলল, না না স্যার। আমি ইভেন্ট অর্গানাইজ করি। ওখানে একটা ক্লাবে আবৃত্তি ও নাটকের প্রশিক্ষণ দিই।
বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গনে যে এত খুন-খারাবি, টেন্ডারবাজি. ছাত্র-শিক্ষকদের দলবাজির খবর পত্রিকা ও টিভিতে পাই; তার বিন্দুমাত্র কি ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, এমনকি পাকিস্তানে রয়েছে (জঙ্গিদের স্কুল গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ছাড়া)! মানবাধিকার বিষয়ে আইনজীবীদের এক সভায় পাকিস্তানে গিয়েছিলাম গত বছর। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সন্ত্রাসের খবর সেখানকার পত্রিকায় দেখিনি। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টারত শ্রীলংকার মানুষ ক'জন বিদেশে যান চিকিৎসা নিতে বা পড়তে? অথচ দেশটির শতভাগ লোক অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। জাতিসংঘ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোতে তারা প্রতাপের সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব দূর করা গেলে, ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের উপযুক্ত সম্মান নিশ্চিত করা গেলে আমরাও সুনাগরিক ও উন্নত দেশের বাসিন্দা হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবো। এ জন্য প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষার পাশাপাশি পিতা-মাতা তথা অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের নৈতিকতা ও সুনাগরিক হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।
প্রাকৃতিক সম্পদে অপ্রতুল রাষ্ট্রও শিক্ষার মানের কারণে সম্পদশালী দেশে পরিণত হতে পারে। তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর বা অন্য অনেক রাষ্ট্র্রের প্রধান আয় সার্ভিসিং সেক্টর। তারা এ থেকে লব্ধ আয় দিয়েই আজ বিশ্বের প্রথম সারির দেশের কাতারে ঠাঁই করে নিতে সক্ষম হয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা তাদের প্রধান সহায়। তাই আমাদেরও বুঝতে হবে যে, উন্নত জীবন লাভ করতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষার বিকল্প নেই। অনেক রাষ্ট্র প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও কেন গরিবই থেকে গেছে, তার উত্তরও উপযুক্ত শিক্ষা না পাওয়ার মধ্যেই খুঁজতে হবে। তেল সম্পদে সমৃদ্ধ নাইজেরিয়ার দরিদ্র দশা এর বড় উদাহরণ।

হামিদুল হক : আইনজীবী
 

No comments

Powered by Blogger.