জেলা প্রশাসক সম্মেলন

চিহ্নিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন শুধু প্রশাসনের দলীয়করণ নয়, দেশে সরকারি প্রশাসনের সমান্তরালে দলীয় প্রশাসন গড়ে তোলায় উন্নয়নকাজ থেকে শুরু করে ত্রাণ-সাহায্য বিতরণ পর্যন্ত সর্বত্রই এক নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করেন সংসদ সদস্যরা।


বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা চলে গেছে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে। উন্নয়নকাজে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি প্রতিদিনই বাড়ছে। সরকারি দল ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি দলীয় ব্যানারে পরিচালিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যরা এখন কোনো প্রশাসনকেই তোয়াক্কা করে না। দলীয় হস্তক্ষেপে পুলিশের চেইন অব কমান্ডও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে ক্রমাগত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে চলেছে। অস্ত্র ও মাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালানও চলে গেছে দলীয় সিন্ডিকেটের হাতে। প্রশাসন তাদের কাছে অসহায়। অনেক ক্ষেত্রেই চেয়ে দেখা ছাড়া তাদের করার কিছুই থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে আগামীকাল মঙ্গলবার শুরু হতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসকদের তিন দিনের সম্মেলন। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্মেলন সামনে রেখে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকরা মোট ৪৬৬টি সমস্যা ও সমাধানের সম্ভাব্য উপায় লিখিতভাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছেন। সেখানে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে যে জরুরি ভিত্তিতে সমস্যাগুলোর সমাধান করা না হলে বাংলাদেশকে ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও সমাধানের পথনির্দেশ করা নিঃসন্দেহে একটি ভালো কাজ। জেলা প্রশাসকরা এ জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ আশা করতে পারেন। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন প্রধানত নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
জেলা প্রশাসকদের উল্লিখিত সমস্যাগুলোর মধ্যে কিছু সমস্যা নতুন হলেও অধিকাংশ সমস্যাই পুরনো। জেলা প্রশাসকরাও অতীতের সম্মেলনগুলোতে অনেক সমস্যাই তুলে ধরেছিলেন; কিন্তু সমাধান হয়নি। ইতিমধ্যে অনেক সমস্যার মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে তা রীতিমতো আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্থাপিত সমস্যাগুলোর মধ্যে দৈনন্দিন কাজের সমস্যা যেমন আছে, তেমনি আছে অনেক নীতিগত সমস্যাও। নতুন শিক্ষানীতির ইতিবাচকতা, শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিকতা- সব কিছুকে ম্লান করে দিচ্ছে দেশব্যাপী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতে থাকা অব্যাহত দুর্নীতি। শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকার ঘুষ-বাণিজ্য নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়তই খবর বেরোচ্ছে। কোথাও কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়া। কিন্তু সেসবের প্রতিকার নেই। ভূমি ব্যবহারের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন ও তার প্রয়োগ না থাকায় সারা দেশেই দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে কৃষি জমি। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার গরু-মহিষ আসে। বৈধভাবে আমদানির সুযোগ না থাকায় এর পুরোটাই আসে চোরাচালানের মাধ্যমে। এই বিশাল অবৈধ বাণিজ্যের কারণে সীমান্তে গড়ে উঠেছে অপরাধীদের বহু শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধেও জড়িত। ফলে সীমান্ত এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ যেমন ঘটে, তেমনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বা বিএসএফের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাও বেড়ে যায়।
জেলা প্রশাসকদের অতীতে অনেক অভয় দেওয়া হয়েছে, দলীয়করণের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে প্রশাসনকে দলীয় করা নয়, দলীয় প্রশাসন চালু করা হচ্ছে। আমরা এই স্ববিরোধিতার অবসান চাই। সরকারি প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রশাসনকে যার যার এখতিয়ার অনুযায়ী হস্তক্ষেপমুক্তভাবে কাজ করতে দেওয়াটাই শ্রেয়। সংসদ সদস্যদের এখতিয়ার একজন আইনপ্রণেতার এখতিয়ারে সীমিত রাখাই যুক্তিযুক্ত। আর উন্নয়নকাজে গতিশীলতা আনার স্বার্থে প্রশাসনে দলীয় নেতা-কর্মীদের হস্তক্ষেপ কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। আমরা আশা করি, মহাজোট সরকার তাদের বাকি সময় সেই সদিচ্ছার পরিচয় দেবে।

No comments

Powered by Blogger.