প্রশান্তি ও সুস্থ জীবনাচার হৃদরোগ নিরাময় করে by ডা. নুরুল ইসলাম

বিশ্বে প্রতিবছর দেড় কোটিরও বেশি মানুষ হদরোগে মৃত্যুবরণ করে। ভুল জীবনাচার, ধূমপান, অবৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমহীনতা, মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় শুধু ওষুধ, এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস অপারেশনের মাধ্যমে রোগীর ব্লকেজের চিকিৎসা করা হয়।


কিন্তু চিকিৎসক-জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, অত্যধিক মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা হৃদরোগের একটি অন্যতম প্রধান অনুঘটক। যার কোনো সমাধান প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় নেই। উপরন্তু অপারেশনের পর রোগী যখন আবার ধূমপান, ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবারসহ পুরনো জীবনযাত্রায় ফিরে যায়, সে আবারও আক্রান্ত হয় হৃদযন্ত্রের নানা জটিলতায়। তাই হৃদরোগ থেকে পরিপূর্ণ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন ধূমপান বর্জন, জীবনধারার পরিবর্তন ও টেনশনমুক্ত জীবন। আমি আমার রোগীদেরও এসব ব্যাপারে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিতাম। আর টেনশনমুক্ত জীবনের জন্য মেডিটেশনের ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
মেডিটেশন ও জীবনাচার পরিবর্তনের মাধ্যমে যাঁরা হৃদরোগমুক্ত হয়েছেন, আমি তাঁদের অভিনন্দন জানাই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই অপারেশন-পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারতেন, কিন্তু তা না হয়ে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাটি তাঁরা নিতে পেরেছেন। অপারেশনকে ভয় করেন না এমন মানুষ নেই, তাই অপারেশনের চেয়ে ঝুঁকিহীন ও সংকটমুক্ত এমন একটি চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে সুস্থ হওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। হৃদরোগ থেকে মুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁদের নিজেদের মুখেই আমি শুনেছি।
প্রযুক্তির ক্রম উৎকর্ষের ফলে শহরে কিংবা গ্রামে কোথাও আমরা এখন আর হাঁটি না, সর্বত্রই গাড়িতে চলাচল করি। অর্থাৎ আমাদের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে শারীরিক পরিশ্রমহীন। আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শাকসবজির বদলে এখন আমরা ফাস্টফুড, ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আসলে যে খাবার যত স্বাদযুক্ত, তা আমাদের শরীরের জন্য ততটাই বিপজ্জনক। আর ধূমপানের কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ সিগারেটে থাকা নিকোটিন করোনারি ধমনিকে সংকুচিত করে এবং এতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, যা করোনারি হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া যুক্ত হয়েছে আধুনিক জীবনের নানা দুশ্চিন্তা ও টেনশন। তাই ধূমপান বর্জন, পরিমিত খাবার, প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রম ও মনে প্রশান্তি আনতে পারলে সুস্থ থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমেরিকায় ডা. ডিন অরনিশ শত শত হৃদরোগীকে এনজিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস ছাড়াই সুস্থ করে তুলেছেন।
Braunwald's Heart Disease' বইটির অষ্টম সংস্করণে ১১৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায় রয়েছে_'মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যথা-বেদনা ও দুশ্চিন্তা দূর করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এ পদ্ধতিতে মানসিক চাপ কমে ও রোগ নিরাময় সম্পন্ন হয়। মেডিটেশন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়।'
আমি বিশ্বাসের সঙ্গে যে কথাগুলো বললাম, তাতে আমার পেশার কোনো ক্ষতি হবে না। আমার পেশা তার যোগ্য সম্মান নিয়েই বেঁচে থাকবে। প্রত্যেক চিকিৎসককেই তাঁর পেশাগত জীবনে এমন কিছু রোগীর সংস্পর্শে আসতে হয়, যাঁদের রোগের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে টেনশন জড়িত। দেখা গেছে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে যেসব রোগী যান, তাঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশেরই কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। কাউন্সেলিং বা সৎ পরামর্শ, আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি এবং প্রশান্তিতে এসব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া হয়। কোয়ান্টাম মেডিটেশন এভাবেই মানুষের মনে প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে রোগ নিরাময়কে ফলপ্রসূ করে, যা এখন পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত। কারণ অস্থির ও অশান্ত আধুনিক মানুষের জীবনে প্রশান্তির সুবাতাস আনতে পারে মেডিটেশন।
ডা. ডিন অরনিশ তাঁর 'রিভার্সিং হার্ট ডিজিজ' বইয়ে মনের এ শক্তি সম্পর্কে লিখেছেন_'হৃদরোগীরা কল্পনায় সব সময় দেখেন ব্লকেজযুক্ত করোনারি ধমনি, কিন্তু তাঁরা যখন পরিকল্পিতভাবে সুস্থ ও পরিষ্কার করোনারি ধমনি অবলোকন করেন, তখন সত্যিই একসময় ধমনির জমাটবদ্ধ কোলেস্টেরল ধীরে ধীরে নিঃসরিত হতে শুরু করে।' কথায় আছে, Patient cure themselves, Doctors show the way. অর্থাৎ আপনার সুস্থতা ও নিরাময়ের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্র তথা সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য সঠিক জীবনদৃষ্টি বা শোকরগোজার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করুন। প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন, নিয়মিত হাঁটুন, ব্যায়াম করুন এবং টেনশনমুক্ত জীবনযাপন করুন।
মানবজাতি সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কারণ মানুষের বিবেক, বিচার-বিবেচনা অন্য সব প্রাণীর চেয়ে ব্যাপক, বিস্তৃত এবং সুতীক্ষ্ন। আর শরীরের চেয়ে মনের ক্ষমতা অনেক বেশি। মনের গতি, শক্তি, পরিধি_সবই ব্যাপক। মনের দুর্দমনীয় শক্তির প্রভাবে শরীরে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, তাতে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় এবং রোগপ্রতিরোধ ও নিরাময়ের শক্তি বাড়ে। শুধু তা-ই নয়, আত্মবিশ্বাস এবং প্রশান্তিও নিরাময়ের সহায়ক বলে গবেষণায় প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায়_'ডযবৎব সরহফ মড়বং, energy flows.' বর্তমানে সারা বিশ্বে রোগ নিরাময় এবং প্রতিরোধের এ প্রক্রিয়া সর্বজনস্বীকৃত এবং গ্রহণযোগ্য। মেডিটেশনের মাধ্যমে টেনশনমুক্ত জীবনযাপন এবং মনের প্রশান্তি এ রোগ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান সহায়ক। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি অনেক সুফল বয়ে এনেছে। নজরুলের একটি কবিতায় আছে, 'বিশ্বাস এবং আশা যার নাই, তার কাছে যেও না।' জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বলিষ্ঠ উচ্চারণ দুর্বল মনে শক্তি জোগাবে, মনে আশা এবং বিশ্বাসের সৃষ্টি করবে। রোগমুক্তি কামনা সফল হবে। বিশ্বাস এবং আশা আমাদের সবাইকে শক্তি এবং সফলতার দিকে এগিয়ে নিক। সবাই মুক্তি লাভ করুক। অর্থের বিনিময়ে নয়, সহৃদয় হয়ে, সঠিক নির্দেশনা দিয়ে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করার মাধ্যমে মানুষকে সুস্থতা এনে দেওয়া চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : জাতীয় অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.