পদ্মা সেতু ॥ নতুন দাতা গ্রুপ?-০ বিশ্বব্যাংককে বাদ রেখে নতুন দাতা গ্রুপ সৃষ্টির চেষ্টা শুরু -০ মূল দাতা হিসেবে আলোচনা চলছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে by হামিদ-উজ-জামান মামুন

বিশ্বব্যাংককে বাদ রেখে পদ্মা সেতুর জন্য দাতাদের নতুন গ্রুপ তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে কাজও শুরু করেছে সরকার। এর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বিশ্বস্ত সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।


এ ক্ষেত্রে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে লিড এজেন্সি করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এবং আগ্রহী অন্যান্য দাতা সহযোগী অর্থায়নকারী হিসেবে থাকবে। ইতোমধ্যেই এডিবির বাংলাদেশে নিযুক্ত আবাসিক প্রতিনিধি তেরেসা খো বৈঠক করেছেন ইআরডির সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে। তবে বৈঠকে কি নিয়ে কথা হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পূর্বনির্ধারিত না হলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর তেরেসা খো রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে আসেন এবং সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। এডিবির বাংলাদেশ অফিসের একটি সূত্র জানায়, তেরেসা খোর এটি নিয়মিত কাজের অংশ। মাঝে মাঝেই তিনি ইআরডিতে যান। সরকারের পক্ষ থেকে এখনও লিড এজন্সি করার প্রস্তাব তারা পায়নি, তবে সরকার চাইলে বিষয়টি ভেবে দেখবে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, শুরুতেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ প্রদানকারী সংস্থার লিড বা নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি)। লম্বা একটা সময় পর্যন্ত এডিবি এই প্রকল্পের লিড ডোনারও ছিল। এবং তাদের টাকা দিয়েই ২০০৪ সালে সেতুর নকশা তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে জাইকার টাকায় করা হয় সম্ভাব্যতা যাচাই। তখন বিশ্বব্যাংক কোন সহযোগিতায় ছিল না। ২০০৯ সালের শেষের দিকে এসে পটপরিবর্তন হয়। এডিবির জায়গায় ঋণ প্রদানকারী সংস্থার নেতৃত্ব দেয়া হয় বিশ্বব্যাংককে। সেসময় নেতৃত্ব থেকে এডিবিকে সরানো হলেও সংস্থাটির সঙ্গে কোন আলোচনাও করা হয়নি। পরে বিশ্বব্যাংককে নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে বলে এডিবিকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়। এ প্রেক্ষিতে এডিবি এতে নাখোশ হয়। পরিস্থিতি সামলাতে সেই সময় লিড এজেন্সি কথাটি বাদ দিয়ে নাম দেয়া হয় মূল অর্থ প্রদানকারী সংস্থা। এ ঘটনার কারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এডিবির তখনকার কান্ট্রি ডিরেক্টর থেবা কুমার কান্দিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি যাননি। সংস্থাটির পক্ষ থেকে মধ্যম পর্যায়ের এক কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। এডিবির বাংলাদেশ মিশন সূত্র জানায়, মূল নকশা প্রণয়নের পর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এডিবি আলোচনার মাধ্যমে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ানো সম্ভব ছিল। এ ধারাবাহিকতায় ঋণ দ্বিগুণ করে প্রয়োজনে আরও বাড়ানো যেত। কিন্তু আলোচনা না করেই নেতৃত্ব পরিবর্তন করায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এর ফলে নতুন করে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি এডিবি। যদিও এডিবি অন্য যে কোন প্রকল্পের চেয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে সব সময়ই অনেক বেশি আগ্রহী।
অন্যদিকে পদ্মা সেতুর অবস্থান সঙঙ্কটকে কেন্দ্র করে আজ সোমবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে দাতাদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক (এলসিজি)। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি দাতাদের সামনে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিলের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবেন। পাশাপাশি কিভাবে বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে এ সেতু তৈরি করা যায় সেসব বিষয়ে দাতাদের পরামর্শ চাইবেন। বৈঠকে কো-চেয়ারের দায়িত্ব পালন করবেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ এবং ইউএনডিপির আবাসিক প্রধান নীল ওয়াকার। বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টরসহ বাংলাদেশে কর্মরত সব দাতা সংস্থা ও দেশের স্থানীয় প্রধানরা এতে অংশ নেবেন।
তবে এ বৈঠকে অন্য ডোনারদের পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের আহ্বান জানানো হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, সরাসরি আহ্বান জানানোর ফোরাম এটি নয়। সে হিসেবে বলা যায় সেটি করবেন না অর্থমন্ত্রী। কেননা তিনি নিজেও দীর্ঘদিন ইআরডিতে চাকরি করেছেন। সেটি করাও ঠিক হবে না। যেটি হবে সেটি হচ্ছে পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে দাতাদের কাছে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ চাওয়া।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে সময় এবং আর্থিক দিক দিয়ে ব্যাপক ভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। এছাড়া জিডিপির আকারও বেড়ে যাবে। সরকারের চালানো এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর নিট আর্থিক সাহায্য ৫০ কোটি ডলার হবে। আর্থিক লাভের পরিমাণ ২০৪৪ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ১ হাজার ৬২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এখানে সময়ের বিষয়ে বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে খুলনায় পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে ১৭০ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা। সেখানে মাওয়া ফেরি দিয়ে পার হলে সময় প্রয়োজন ১২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। এতে সময় বাঁচবে ৯ ঘণ্টা ১৫ মিনিটি। আর ঢাকা থেকে যশোরে পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে সময় বাঁচবে ৯ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। এ সেতু নির্মিত হলে উন্মোচিত হবে যোগাযোগর নতুন দিগন্ত।
এ প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া অন্যান্য দাতা সংস্থার মধ্যে ওই বছরের ১৮ মে জাপানের সঙ্গে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান বিষয়ক চুক্তি করে সরকার। ২৪ মে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ১৪ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৬ জুন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা (৬১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শেষ হয়।
কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের দরপত্রে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। সংস্থার পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছিল। সেখানে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন সাকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। যোগাযোগ মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন পেলে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেই কাজ পাইয়ে দেয়ার বিষয়ে সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে অবশেষে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ওবায়দুল কাদেরকে।
সূত্র জানায়, এদিকে ঋণ কার্যকারিতার মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ সময় পার হওয়ার পূর্বেই সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয় এডিবি ও জাইকা এবং ৬ মাস সময় বাড়ায় বিশ্বব্যাংক।
এডিবি ও জাইকার বাড়ানো মেয়াদ গত ২৭ এপ্রিল শেষ হয়ে গেলে ঋণ কার্যকারিতার সময় দ্বিতীয় মেয়াদে আরো তিন মাস বাড়ায় এডিবি এবং জাইকা। এ সেতুতে ঋণ দাতা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কারী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের আগামী ২৭ জুলাই পর্যন্ত ঋণ কার্যকারিতার সময় রয়েছে। তাই এডিবি এবং জাইকাও ওই সময় পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদে ঋণ কার্যকারিতার এ সময় বাড়িয়েছিল।
কানাডা পুলিশের তদন্ত এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি, ঋণ কার্যকারিতার সময়ও রয়েছে প্রায় একমাস (২৭ জুলাই পর্যন্ত), বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনও যখন তদন্ত অব্যাহত রেখেছে ঠিক সেই মুহূর্তে গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে আকষ্মিকভাবে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিশ্বব্যাংকের চুক্তি বাতিলের দুদিন পর সোমবার পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা থেকে সরে গেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ওই দিন জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছে, জাইকা সরছে না। আইডিবি এখনও কোন মতামত জানায়নি।

No comments

Powered by Blogger.