সিডনির মেলব্যা-চেতনা অবিনাশী স্বপ্নযাত্রার গল্প by অজয় দাশ গুপ্ত

বাংলাদেশের সম্পদ তার মেধাবী ও পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী, এঁরা দেশ ও দেশের বাইরে সর্বক্ষণিক তৎপর। এঁরা মেধা ও শ্রমে নিজেদের জীবনকে নিরাপদ করেই ক্ষান্ত দেন না। দেশ জনগণ নিয়েও ভাবেন তাঁরা। ভাবেন বলেই দেশের সুখে আনন্দিত আর দুঃখে বেদনার্ত হয়ে ওঠেন। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জন্য দেশ কখনও বিপদে পড়েনি।


কখনও তার বদন মিলন হয়নি। যা কিছু অঘটন যা কিছু বদনাম তার পেছনে বরাবরই ‘বড়’ বলে চিহ্নিত মানুষের হাত দেখি আমরা। এতই বড় তার নাগাল মেলে না। গত কিছুদিন ধরে সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীদের মনে কষ্ট আর দুঃখ দানা বেঁধেছে। সদুত্তর মিলবে না জেনেও তাঁরা প্রশ্নাকুল। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাÑ যাবতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার মতামত বা বক্তব্য দেশে বসে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব, বিদেশে নয়। প্রবাসের বাংলাদেশীদের ভাবমূর্তি ও ইমেজ বহুলাংশে সেই সব দেশ বা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল। বহুজাতিক দেশ বা সমাজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেউ কাউকে বোঝায় না, সমঝোতা বা দ্বিমত নিরসনে দেখাশোনার সুযোগও খুব কম। এ কারণে মিডিয়ার ওপরই নির্ভরতা। বলাবাহুল্য, উপমহাদেশের তুলনায় অনেক বেশি সৎ ও নিরপেক্ষ বলেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ওপর বিদেশী বা অন্যান্য দেশের মনযোগ সঠিক। সে মনযোগে বাংলাদেশ আবারও দুর্বিপাকে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ-বিদেশে বাঙালীর স্বপ্ন নতুনভাবে জেগে উঠেছিল। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের অতন্দ্রপ্রহরী সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর তথা বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর মানুষের আস্থাই স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল। এই সরকারের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ঘাতক দালালদের বিচার, জঙ্গীবাদ নির্মূলে আগ্রহ আর তারুণ্যের উদ্ভাসে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের পজেটিভ হাওয়া বয়ে যায়। ধীরে ধীরে তার আঁচ বা হাওয়া কমে এসেছে। অন্যদিকে কিছু মন্ত্রী বা ক্ষমতাধরের ভূমিকায় ভাবমূর্তি পড়ছে তোপের মুখে। মনে পড়ে জোট সরকারের আমলে আমরা কি ধরনের নেতিবাচক মনোভাবের শিকার হতাম। একবার স্থানীয় এক অনুষ্ঠানে এ দেশের উচ্চ পর্যায়ের এক নেতা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন : ‘তোমাদের দেশে কি বিবেকবান মানুষ নেই? তোমরা কি করে এত অন্যায় আর দুর্নীতি সহ্য কর?’ একবার সিডনি জুড়ে ক্ষোভ বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের মুখেও পড়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া। সিডনি নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অভিজাত হোটেলের সামনে প্রতিবাদমুখর অপরাহ্ণে শামিল হয়েছিল বেশ কিছু স্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ান। ভেবেছিলাম হয়ত বা ঝোঁকের বশে এমনও ধারণা হয়েছিল তামাশা দেখার জন্য বা মজা করার জন্য শামিল হয়েছিল তাঁরা। সে ভুল ভাঙ্গল মুহূর্তেই। পরিষ্কার শুদ্ধ উচ্চারণে জঙ্গীবাদ মুক্ত বেংলাদেশ, বেংলাদেশ চায় বলে স্লোগান দেয়া অজিরা জানিয়ে দিয়েছিল তাঁরাও খবর রাখে। তাই আজ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের মনে আবার কালো মেঘের আনাগোনা। যেটুকু উজ্জ্বল উদ্ধার সেটুকু আবারও ঢেকে যাচ্ছে হতাশার কালো ছায়ায়। আমরা প্রবাসে দেশের রাজনীতি ছড়িয়ে পড়ার ঘোর বিরোধী। আমরা চাই না যুবক-যুবতীদের মাথা খাওয়ার জন্য অমুক লীগ, তমুক লীগের জন্ম হোক। এও চাই না এসব দলবাজির আড়ালে ঘাপটিমারা একদা শিবির কর্মী রাতারাতি আওয়ামীবান্ধব হয়ে উঠুক। সিংহভাগ প্রবাসীর প্রার্থনা দেশের মঙ্গল। তারা রাজনীতি নয়, দেশ মাতৃকার উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিনিময় চায়। বর্তমান সরকারের ভাল কাজগুলো ঢাকা পড়ে গেলে আগের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া বিদেশীরা আমাদের ইতিহাস বা অতীত নিয়ে মাথা ঘামায় না, তাঁদের ধর্তব্য বর্তমান। এখন অবদি বর্তমান সরকারের প্রতি আনুকূল্য ও সমর্থনের কারণও তাই অর্থনৈতিক আর সামাজিক প্রগতি। পদ্মা সেতু বা অন্যান্য বিষয়ে ধারণা ও ভাবনা যত নেগেটিভ হবে ততই দেশের ইমেজ পড়বে বিপাকে। আমরা দূর থেকে আকাশে মেঘের আগমনী বার্তা টের পাচ্ছি। আশা করি সরকার ও প্রশাসন তা বুঝে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে, আশাহত বাংলাদেশ, জামায়াত বা জঙ্গী সমর্থিত সরকারের বাংলাদেশ আর যাই হোক গণতান্ত্রিক বা মুক্ত হতে পারে না। কে আমাদের আশার আলো দেখাবে? কে নিয়ে যাবে সুন্দরের পথে?

স্বপ্নযাত্রার শেষ আয়োজন
মানুষ প্রবাসী হয় নানা কারণে। এককালে বলা হত : প্রবাসে দৈবের বশে। এখন তা ঠিক বলা চলে না। মানুষ জেনে বুঝে কাঠখড় পুড়িয়ে প্রবাসী হয়। বিশেষত অভিবাসনের দেশে আমাদের মতো দরিদ্র মানুষ আসেন উন্নত ও নিরাপদ জীবনের সন্ধানে। নিজেদের মেধা, শ্রম আর যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবেই এসব দেশে পা রাখতে হয়। তেমনই এক দম্পতি পরমেশ ও স্বপ্না ভট্টাচার্য। সুখের সংসার তাঁদের কন্যাপুত্র নিয়ে জমজমাট পরিবার। বেশ কিছুদিন থেকেই কর্কট রোগে ভুগছিলেন স্বপ্না ভট্টাচার্য, ভোরবেলা অফিস যাবার পথে মোবাইলে ভেসে এলো দুঃসংবাদ, বাংলাদেশ অর্থাৎ জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে, স্বপ্নযাত্রার স্বপ্ন ভূমিতে নিঃসঙ্গ পরপাড়ের যাত্রী হয়েছেন স্বপ্না ভট্টাচার্য। এই সেদিন গায়ক তপন চৌধুরীকে ঘিরে আনন্দ সন্ধ্যার এক অড্ডায় দেখা হয়েছিল। তখন কি জানতাম সেই হবে শেষ দেখা? নিয়তি বলে মানুষের জন্ম মৃত্যু বিবাহ অনিশ্চিত ও দৈব শক্তির ইচ্ছাধীন, হবে হয়ত বা, নইলে দূর দেশে অন্য মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস যাবে কেন? কেনই বা দেশের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন অহমেদও লড়ছেন বিদেশের মাটিতে। যেখানে তাঁকে কেউ চেনে না, জানেও না তিনি কত মানুষের অন্তরের ভালবাসায় সিক্ত একজন বাঙালী, হায়রে নিয়তি ॥
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.