আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও বাংলাদেশিদের অবস্থা by পারভীন আফরোজা

ঘন বসতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে পরিচিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞানের যেমন উন্নয়ন ঘটেছে, তেমনই মানুষের জন্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রেরও সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশ তথা সারা বিশ্বের মানুষের মবিলিটি বেড়ে গেছে। গত ১০ বছরে মানুষের আন্তর্র্জাতিক অভিবাসন বা মাইগ্রেশনের সংখ্যা যেন দ্রুত বেড়ে চলেছে।


কর্মসংস্থান অর্থাৎ রুটি-রুজির সন্ধানে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে আত্মীয়-পরিজন রেখে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে বছরের পর বছর অবস্থান করে। কিন্তু এ অভিবাসন বহু মানুষের জন্যই নিরাপদ হচ্ছে না এবং তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের অসুবিধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বিশাল পরিমাণের অর্থ ব্যয় করে জীবনমান উন্নয়নের জন্য মানুষ অভিবাসন করতে গিয়ে অনেকেই ভুয়া আদম বেপারীর খপ্পরে পড়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, অনেকেই আবার ভালো চাকরি পেয়ে অথবা ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে এ অভিবাসনের মাধ্যমেই। তবে শোভন বা যথোপযুক্ত কাজের জন্য অভিবাসনের চেষ্টা উত্তরোত্তর মানুষ চালিয়ে যাচ্ছে। আইওএম এ বিষয়ে যদিও কাজ করছে, তবে তা খুব সীমিত আকারে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শোভন কাজের প্রমোশনের জন্য পাইলট কার্যক্রম চালিয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে এই পাইলট কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। আন্তর্জাতিক অভিবাসন নিয়ে বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারণী-পর্যায়ে এ বিষয়ে অনেক কথাবার্তা ও আলোচনা চলেছে। তবে এ কাজটিও খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে চলে। বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন দেশ অভিবাসী মানুষের জন্য শোভন ও যথোপযুক্ত কাজের সংকুলান করবে এবং প্রত্যেক অভিবাসীর মানবাধিকার সুরক্ষা করবে_সারা বিশ্বের কাছে এটাই আমার দাবি।
প্রবাসে মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ। কিন্তু এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিবিড় নিরীক্ষণের মাধ্যমে মানুষের মানবাধিকার যাতে রক্ষা হয়, সেদিকে সরকারের নজরদারি আরো বাড়ানো দরকার। যাতে অভিবাসীরা নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার না হয় সে বিষয়ে প্রতিটি দেশের দূতাবাসগুলোর কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। কারণ বিদেশি শ্রমবাজার থেকে বাংলাদেশের আয় প্রতিবছর ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও অনেক বেশি। এই আয়ের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করতে হলে আন্তদেশীয় শ্রমিকের শ্রমদক্ষতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা, বিদেশের দূতাবাসগুলোতে দক্ষ প্রতিনিধিকে পদায়ন করে তাদের দিয়ে ওই দেশের বাজার যাচাই করা এবং সে মোতাবেক শ্রমিক সরবরাহ করার জন্য দেশে পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত দরকার। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি লেখাপড়া, শোনা এবং বলার চর্চা বাধ্যতামূলক করাও অত্যন্ত প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষকদের অবশ্যই প্রশিক্ষণদান প্রয়োজন। অর্থ আপাতত কিছু খরচ হলেও সরকারের এ উদ্যোগ অনেক বড় ফল দেবে_এ আমি হলফ করে বলতে পারি। এ বিষয়ে জাতীয়পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আরো বেশি পলিসি ডায়ালগ হওয়া দরকার, যা আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমূল পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের নামে মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে শ্রমিকের টাকা দেশে আসার সময় একটা বড় অংশ তাদের ছাড় দিতে হয়। এই খরচ আরো কম হওয়া দরকার। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার কার্যক্রম সীমিত আকারে চলছে। এ জন্য বিশাল বিশ্বশ্রম বাজারের দুর্নীতি দমন করা তাদের পক্ষে কোনো দিন সম্ভব নয়। উন্নত দেশের মানুষরা অনেকেই আমাদের দেশের মজুরদের যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করছে। তাদের উপযুক্ত মজুরি দিচ্ছে না, তাদের জীবনযাত্রার মান শোভন তো নয়ই, বরং তা একেবারে নিম্নমানের। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোও শ্রমিকদের খুব বেশি সহায়তা দিতে পারছে না। ২০০৪ সালে ঢাকায় বিশ্বায়ন ও শোভন কাজের ওপর একটা নীতিনির্ধারণী আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু এর ফলস্বরূপ বাংলাদেশ তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. তাসনিম সিদ্দিকী এ বিষয়ে লেখালেখি করছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের রিটা আফসার আন্ত-অভিবাসীদের নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু আমাদের এই লেখাপড়ার সুযোগ আদৌ নীতিনির্ধারকদের আছে কি না আমার সন্দেহ। আন্তর্জাতিক অভিবাসনের হার গত ২০০০ সালে তিন শতাংশ ছিল এবং তা ১০ বছরে অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় অভিবাসী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ তেমন একটা বাড়েনি। আমাদের দেশে যত আন্তর্জাতিক অভিবাসী আছে, এর ৮০ শতাংশ বিদেশে যাচ্ছে শ্রমিক হিসেবে এবং জীবন-জীবিকার তাগিদে। তাদের অনেকে দুর্বিষহ জীবন কাটানোর পরও পরিবারের রুটি-রুজির কথা চিন্তা করে দেশে ফিরে আসতে পারছে না। এ ছাড়া শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বেকারত্বের হারও অনেক বেড়ে গেছে। অল্প শিক্ষিত হওয়ার পর তারা দেশে মুটে-মজুরের কাজে যেতেও লজ্জাবোধ করছে। আবার তাদের উপযোগী কাজও খুঁজে পাচ্ছে না। এ জন্য মজুর হিসেবে বাইরে কাজে যাওয়ার জন্য তাদের কেউ পরিবারের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেও বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেখানে আমি দেখেছি, এক ঘরে ২০ জন পর্যন্ত বাংলাদেশি গাদাগাদি করে বাস করে। অনেকে বরফপড়া ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে হকারের কাজ করে, কেউ খনিশিল্পে কাজ করে, কেউ হোটেলে, আবার কেউ ঝাড়ুদার বা রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে। অনেকেই আছে যারা ঘরে ঘরে পেপার দিয়ে আসে, কেউ বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করে। অনেকেই অত্যন্ত নিম্ন বেতনে পরিবার-পরিজন রেখে গিয়ে কাজ করে। অসচেতনতার জন্য অনেকেই এইডসের মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়ে ফেরত আসে। আবার কেউ বেতন এত কম পায় যে নিজে খেয়ে-পরে যা বাঁচে তা দিয়ে দেশের ঋণ শোধ দেয়, যা সে বিদেশে আসা বাবদ খরচ করেছে। তবে শুধু যে অভিবাসনের নেতিবাচক দিক আছে তা নয়, অনেক ইতিবাচক দিক ও সাফল্যও জড়িয়ে আছে। অনেকের জীবন সার্থক হয়েছে মাইগ্রেশন করার পর, যেখানে তারা দেশে তেমন কোনো ভালো কর্মসংস্থানের জায়গা করতে পারছিল না। আশা করি, আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা শ্রমিকের শোভন কাজের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করে শ্রমিকের মানবাধিকার রক্ষায় সহায়তা করবে। সরকার জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদান করে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করবে। বিদেশে যাঁরা জনগণের চাকরির ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা সেসব অভিবাসীর মানবাধিকারের বিষয়টি লক্ষ রাখবেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমার আবারও আকুল আবেদন, নিরাপদ অভিবাসনের লক্ষ্যে কাজ করার। শ্রমিকের মানবাধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রয়োজনে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করা হোক। আদম ব্যবসায়ীদের কাছে আকুল আবেদন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে কাউকে ভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেবেন না। সঠিকভাবে ব্যবসা করুন, দেশবাসীর ভোগান্তি কমে যাবে।
লেখক : নারী উন্নয়ন শক্তির নির্বাহী পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.