বিপ্লবোত্তর মিসর ও ইরানের পথ by অ্যান্টনি শাদিদ
গত তিন দশকের মধ্যে দুজন মিসরীয় নেতাকে গদিচ্যুত হতে হলো। একজন গেছেন ইসলামী জঙ্গিদের বুলেটে, আরেকজন গেলেন হাজার হাজার মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কারণে। ইসলামী জঙ্গিদের দ্বারা নিহত হয়েছিলেন আনোয়ার এল সাদাত। আর বিশ্ববাসী মিসরে বিশাল এক গণবিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে গত শুক্রবার।
পশ্চিমের দুনিয়ায় এই বিপ্লব দেখে এক ধরনের ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সামনে প্রশ্ন, মিসরও কি তাহলে ইরানের পথ ধরে এগিয়ে যাবে? আর এই সন্দেহ কিংবা ভীতির কারণও একটা আছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হলেও এ আন্দোলনের সঙ্গে মৌলবাদী ইসলামী জঙ্গিরা কিন্তু অবস্থান করছিল। এ আন্দোলন কিংবা বিপ্লব মিসরে ইসলামী মৌলবাদীদের প্রবেশপথ তৈরি করে দিয়েছে_এমন সন্দেহও কেউ কেউ করতে শুরু করেছেন, যা হোসনি মুবারকের শাসনামলে ছিল অবাস্তব। তখন ইসলাম সেখানে অনেক উদারভাবে পালিত হতো। মিসরের এই বিপ্লবে যুবসমাজের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। নারী ও শ্রমিকের কণ্ঠস্বরও শোনা গেছে সেখানে। একইভাবে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোও সুর মিলিয়েছে সম্মিলিতভাবে। কারণ প্রত্যেকেই ছিল মারাত্মকভাবে নির্যাতিত। তবে এখানে ইসলামী রাজনৈতিক গোষ্ঠী কিন্তু সহজে তরী বেয়ে যেতে পারবে না। তাদের প্রচণ্ড প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে। তাদের মিসরবাসীর কাছে নতুন করে আস্থা অর্জন করতে হবে। তবে মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা আলী আবদেল ফাত্তাহ শনিবার বলেছেন, নেতা পছন্দ করা সাধারণ মানুষের অধিকার। তারাই তাদের নেতাকে বাছাই করবে। আর শাসক মনোনীত হবেন নির্বাচনের মাধ্যমে। আমি মনে করি, মিসরের মানুষ তাদের কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে_সেই সুযোগটি গ্রহণ করবে। ওই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র তুরস্কই তাদের সরকার পরিচালনার কাজে ইসলামকে তাদের মতো করে ব্যবহারের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যেটাকে এখনো পরিপূর্ণ বলার সুযোগ নেই। ওই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোয়ও দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, ইরাকে আমেরিকার আগ্রাসনের পর সেখানে সশস্ত্র প্রতিরোধের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা শুরু হয়। ফিলিস্তিন ও লেবাননে আগে থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ আছে। সেখানেও তা হয়েছে ইসরায়েলের আগ্রাসনের কারণে।
মিসরে নিবর্তনমূলক সরকারি নীতির কারণে সেখানে ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানকে সহযোগিতা করা হয়েছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশেই এমন ঘটনা ঘটেছে। যেমন আফগানিস্তানের কথাও বলা যায়। ১৯৯০ সালে সেখানে নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থানে চলে যায় আল-কায়েদার নেতৃত্বে জঙ্গিরা। কিন্তু মুবারকের বিরুদ্ধে যে দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তা কিন্তু ভিন্নমাত্রার। সেখানে দাবি ছিল মুক্তির, সুবিচার প্রতিষ্ঠার। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জাতীয়তাবাদের নামে শোষণের দুর্গ ভাঙার আহ্বান। এসব দাবি উচ্চারিত হয়েছে যুবসমাজ, নারী এবং শ্রমজীবী মানুষের মুখ থেকে। আর তারা সেই দাবি উচ্চারণের জন্য ব্যবহার করেছে প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমকে।
মুসলিম ব্রাদারহুডও এ আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। আর তারাও চাইছে আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নতুন একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে। তারাও মনে করছে, সে জন্য মিসরে নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন। মুবারকের বিরুদ্ধে এ আন্দোলনকে সংগঠিত করার ব্যাপারটি খুবই উল্লেখযোগ্য। তবে এ আন্দোলনের মাধ্যমে মিসর যে গণতন্ত্রের দিকে মোড় নিয়েছে, তাও সত্য। কারণ সামনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্তির বিষয়টিও ছিল দাবির একটি অংশ। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী বলে নিজেকে দাবি করেন_এমন একজন হলেন মিসেস বোরহাম। তাঁর দাবি, এটা গতকালের মিসর নয়। তিনি তাহরির স্কয়ারের জমায়েতে ঘোষণা করেন, প্রত্যেক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রত্যেকেই অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। এটা তাঁর নাগরিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তিই সমাজের অংশ। এই প্রতিবাদ কিন্তু ব্রাদারহুডকেও এক দফা ধমক দিয়ে ছেড়েছে। তবে প্রগতিপন্থী অনেকেই দেখেছে, এ আন্দোলনের সঙ্গে এমন পুরনো ধারার সংযুক্তি ঘটেছে, যারা নাকি সামাজিক দুর্গতিগুলো কেন ঘটেছে, এর কোনো সঠিক জবাব দিতে পারবে না। ব্রাদারহুডের কর্মীদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা আছে। বিশেষ করে ব্রাদারহুডের তরুণ কর্মীদের মধ্যেই এ হতাশা বেশি। যে কারণে গত মঙ্গলবারেও তাঁদের এক যুবনেতা ইসলাম লুৎফি বলেছেন, বোঝা যাচ্ছে না ফল কী হবে। বুধবারে তিনি বলেছেন, বিজয় হতেও পারে। বৃহস্পতিবারে বলেছেন, 'ঠিকই আপনারা বড় একটি কাজ করেছেন। এগিয়ে যান আপনারা, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।'
মিসর এগিয়ে যাবে। পরবর্তী নির্বাচন হবে খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, যা আগে কখনো হয়নি। পদ্ধতিগত কারণেই এখনো সব কিছু অন্ধকারে রয়ে গেছে, তা-ও সত্য। যে কারণে ভবিষ্যতেই দেখা যাবে, সত্যিকার অর্থে কার শক্তি কতটা।
সুয়েজ খাল নিকটবর্তী শহর ইসমাইলিয়ায় ১৯২৮ সালে স্কুলশিক্ষক হাসান আল বান্নার হাত ধরে যে ধারার সৃষ্টি হয়, তা ক্রমাগত স্ফীত হয়েছে সেখানে। কিন্তু তাদের মূল ধারায় আসার সুযোগ হয়নি। ১৯৫৪ সালে যখন সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়, তখন গামাল আবদেল নাসের সেই গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আন্দোলনকে দমন করার জন্য নাসের ব্যাপক নির্যাতন, খুন-খারাবি চালিয়েছিলেন। মুসলিম দুনিয়ার কিছু জঙ্গি আছে, যারা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। কিন্তু আন্দোলনে তাদের একাধিপত্য তৈরি সম্ভব হয়নি। কারণ সে আন্দোলনে কিছু বাম ধারার সংগঠনেরও অস্তিত্ব ছিল বলে জানা গেছে। বাম ধারার লোকজনকে ১৯৮৪ সালেও প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে দেখা গেছে। তারাও ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি। তারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।
মৌলবাদীদের এক নেতা ২০০৫ সালে এসে তাঁর মত পরিবর্তন করেন। এমন একজন নেতা, যিনি নাকি স্ল্লোগান দিতেন যে একমাত্র ইসলামই সমাধান দিতে পারে। মুক্তির লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। তবে সরকারের সঙ্গেও মুসলিম ব্রাদারহুডের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে সেখানে। এটা দেখা গেছে, গত মঙ্গলবার যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমার সোলায়মান মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের আলোচনায় ডেকেছিলেন।
এখন প্রশ্ন, তাহলে কি ইরানের বিপ্লবের মতো মিসরেও তেমন কিছু হয়ে গেছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি যে অবস্থায় দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, সে পরিস্থিতি কিন্তু মিসরে নেই। মুসলিম ব্রাদারহুড সে পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি। তাই ইরানের পথ অনুসরণ করে মিসরকে এখন চলতে হবে, এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই।
লেখক : সাংবাদিক
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে সংক্ষেপিত
ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন
No comments