মানুষের মুখ-এক বৃষ্টিতে হকার রাব্বি by ফারুখ আহমেদ

রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি সকাল থেকে। আজকাল প্রতিদিন এমনই চলছে। এখন মনে হচ্ছে, ঠিক ঠিক বর্ষা এসেছে। বর্ষা ঋতু আমাদের প্রত্যেকের খুব পছন্দ। এমন দিনে ঘরে বসে গান শুনব। সঙ্গে খিচুড়ি খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু জরুরি মোবাইল কল পেয়ে বের হতে হলো।


বৃষ্টিতে বাইক অচল, সিএনজিচালিত অটোরিকশার খোঁজ করে বিরক্ত হয়ে রিকশা নিলাম চড়া ভাড়ায়। আজকাল রিকশায় কম ওঠা হয়। আর যখন রিকশা একান্ত নিতেই হয়, তখন এমন দিন নেই যে ঝগড়া হয় না। ভাড়া এমনভাবে বেড়ে গেছে যে রিকশায় ওঠা যায় না, সিএনজিচালিত অটোরিকশা তো পাওয়াই দায়! যা হোক, রিকশায় অনেক কসরত করে মতিঝিলে পৌঁছালাম। এসেছি একটি ব্যাংকে। এখানে কাজ সারতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায়।
যখন ব্যাংক থেকে বের হই, তখনো আকাশভরা বৃষ্টি। আমি বাইরে এসে দাঁড়াই। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রিকশাওয়ালাকে হাত দেখাই, এই সিএনজি বলে চিৎকার করি, কোনো কাজ হয় না। অনেকক্ষণ এভাবে চলে, শেষে একটু হতাশ হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই পাশ থেকে কচি কণ্ঠের উচ্চারণ, ‘রিসকা-সিএনজি কিচ্ছু পাইবেন না। হাইটা চলেন, ভিজ্জা বাড়ি যান।’ এ আবার কে ভেবে, এমন চরম বিরক্তির মধ্যেও তার দিকে তাকাই, নীরব দৃষ্টিতে আপাদমস্তক জরিপ করি। হাফ প্যান্ট-গেঞ্জি পরা হাতভরা পেপার নিয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় একটি শিশু। রোদে-জলে কেমন তামাটে শ্যামলা গায়ের রং। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে আছে। বয়স বড়জোর ১০ হবে। জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমার বয়স নয়। পাঁচ বছর বয়স থেইকা পেপার বেচি।’ আমি বলি, ধুর! এটা কি সত্যি, আচ্ছা, তোমার কি সালটা মনে আছে, ঠিক কবে থেকে পেপার বেচো? ‘না, তয় যেদিন প্রথম ভোরের ডাক বাইর হয়, সেই দিন থেইকা আমি পেপার বেচি।’
সে যাক, দেখে মনে হচ্ছে, বয়স তার নয় বছরই হবে। কিন্তু সে কি পাঁচ বছর বয়স থেকে পেপার বেচে! ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকাই। বৃষ্টি কমার নাম নেই। এ যুগের রানার পেপার হাতের শিশুটি তখনো আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ভাবি, এ দেশের বেশির ভাগ সন্তান এই বয়সে ঘর থেকে স্কুল আবার ঘরে ফিরে, তাও অভিভাবকের সঙ্গে। আর সেই বয়সে এই ছেলেটি নিজেদের প্রয়োজনে দায়িত্ব তুলে নিয়েছে কাঁধে। প্রতিদিন নতুন খবর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
ওকে নিয়ে পাশের চায়ের দোকানে বসি। একটা চায়ের অর্ডার করে ওর কাছে জানতে চাই, ‘চা খাবি?’ সে ‘হ’ বলতেই আমি আরেকটা চায়ের সঙ্গে বিস্কুটের কথা বলি।
রাব্বি তার নাম। পুরো নাম মোহাম্মদ রাব্বি হোসেন। বাড়ি নেত্রকোনা। পরে বলেছে দুর্গাপুর। ঢাকায় থাকে কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডে। তিন ভাই এক বোন তারা। ভাইগুলো আরও ছোট। বোন বড়, বয়স ১২ হবে। নটর ডেম কলেজের মিশনারি স্কুলে পড়ে। রাব্বি নিজেও স্কুলে পড়ত। বাবা আরেকটা বিয়ে করে ওর মাকে ছেড়ে চলে গেলে উপায়হীন হয়ে ওকেই রোজগারে নামতে হয়। সংসারের ভার মায়ের পাশাপাশি তার ওপরও পড়েছে। জীবনের প্রয়োজনে সে নেমেছে জীবিকায়! উদাস করা, কেমন মায়ায় ভরা রাব্বিকে আমি আবার এক পলক দেখে নিই। এখনই তো তার পথে নামার কথা ছিল না। অথচ সে পাঁচ বছর বয়স থেকে পেপার বেচে চলেছে!
কোথা থেকে পেপার নাও?
স্যার, দৈনিক বাংলা মোড় থেইকা।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেপার বেচো?
‘না স্যার, আমি পেপার ব্যাংকের স্যারের গো কাছে বেচি। সব ব্যাংকেই ঢুকতে পারি। খালি ওই ব্যাংকে (বাংলাদেশ ব্যাংক দেখিয়ে) ঢুকতে পাস লাগে। সব পেপার বেচি না, আমার অর্ডার আছে। যেমন সকালের খবর, বণিক বার্তা, ভোরের ডাক, আমাদের সময় আর বড় স্যারে গো প্রথম আলো দেই। প্রথম আলো বেশি চলে, তয় অহন মতিঝিলে বণিক বার্তার কাস্টমার বাইড়া গেছে।’
একটা পেপারে কত পাও?
‘ঠিক নাই, তয় পেপার বেইচা রোজ দেড় শ-দুই শ ট্যাকা আয় হয়। স্যারেরা বকশিশ দিলে হেই দিন বেশি পাই। সব ট্যাকা মায়রে দিয়া দেই। মায় আমারে দশ ট্যাকা দেয়। বিস্কুট খাই, রুটি-কলা কিনা খাই। আগে গেমস খেলতাম, মায় একদিন ইচ্ছামতো মারল, হের লাইগা আর গেমস খেলি না।’
স্কুলে পড়ার ইচ্ছা নেই?
‘পড়ছিলাম তো। একদিন কারেন্টে ধরল, অসুখে পড়লাম। তারপর স্কুল বন্ধ হইল। মায়রে কইছি, মায় কইছে, আমারে আবার স্কুলে দিব।’
রাস্তায় চলতে ভয় লাগে না তোমার?
‘না স্যার, লিফটে চড়তে ভয় লাগে। ব্যাংকে গেলে আমি লিফটে উডি না। বুকটা কেমুন করে, এক্কেবারে শুকায়া যায়। তাই তো স্যারে গো পেপার দিতে আমি হাইডা ওপরে যাই!’
বড় হয়ে কী হবে?
‘স্যার, পেপার বেইচ্চা খুব মজা পাই। ছবি দেহি, লেখা দেহি, ভালা লাগে। তয় পড়তে পারি না। এমুন লেখা আমিও লেখবার চাই! আমার বেশি ভালা লাগে পেপারের ছবি দেখতে। যারা ছবি তুলে, আমি তাগোর লাহান হইতে চাই। তয়, যদি মায় আমারে স্কুলে দেয়। হুনছি, পড়াল্যাখা ছাড়া কিচ্ছু হওয়া যায় না!’
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.