এইচআরডব্লিউ’র বিডিআর প্রতিবেদনঃ বিতর্কে আইনবিদরা, তথ্যতাদাতাদের সুরক্ষার আহ্বান

বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় ‘পক্ষপাত’ ও সন্দেহভাজনদের ওপর ‘প্রচণ্ড নির্যাতন’-এর উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র (এইচআরডব্লিউ) বুধবার প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটির বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে প্রতিবেদনটি তৈরিতে বাংলাদেশের যেসব মানবাধিকার  সংস্থা ও কর্মীদের তথ্য-সাহায্য নেয়া হয়েছে সেসব সংস্থা ও ব্যক্তিদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে হংকং ভিত্তিক আঞ্চলিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি)।

বিশিষ্ট আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক শনিবার বার্তা২৪ ডটনেট’কে বলেছেন এই প্রতিবেদনটি প্রত্যাখান করার সুযোগ নেই। তাছাড়া ধারাবাহিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) আরো অনেক আগেই বিলুপ্ত করে দেয়া দরকার ছিল বলে মনে করেন তিনি।

বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং র‌্যাব অনেক নির্যাতনে জড়িত বলে প্রতিবেদনটি সমর্থন করলেও বাংলাদেশ পুলিশের এ ‘অভিজাত’ ব্যাটালিয়নটি বিলুপ্ত করার পক্ষে নন বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক সুলতানা কামাল। সুলতানা কামাল দীর্ঘদিন ধরে যেই মানবাধিকার সংস্থায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন,  সেই আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সাহায্য নিয়েই তৈরি হয়েছে এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনটি।

এই দুজনের ঠিক বিপরীত মত পোষন করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির এখতিয়ারে সায় দিয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদ-এ (আইসিসিপিআর) বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডব্লিউ’কে ‘বিদেশি সংস্থা’ আখ্যা করে তিনি এ বিষয়ে তাদের ‘হস্তক্ষেপে’র ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি মনে করেন, র‌্যাবের বিলুপ্তির যে দাবি করেছে সংস্থাটি তাতে ‘মাত্রা অতিক্রম’ করেছে।

সরকারের কড়া অবস্থান
বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় ‘পক্ষপাত’ ও সন্দেহভাজনদের ওপর ‘প্রচণ্ড নির্যাতন’-এর উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ’র গত বুধবার সকালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে সরকার। প্রতিবেদনটি প্রকাশের দিন বিকেলেই এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় র্যাব জানায় ‘দরকারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে’। পরে শুক্রবার সকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “এ ধরণের অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ।” সরকারের স্বরাষ্ট্র ও আইন প্রতিমন্ত্রী এ প্রতিবেদনের সঙ্গে ‘দেশকে অস্থিতিশীল করা’র ষড়যন্ত্র আছে বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে বিজিবি (সাবেক বিডিআর) তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়া।

প্রসঙ্গত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র নিজস্ব গবেষকদলের তৈরি করা “ভয় আমাকে ছাড়ে না’: ২০০৯’র বিডিআর বিদ্রোহের পর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও পক্ষপাতদুষ্ট বিচার’’ শীর্ষক ৫৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি তৈরি করতে দেশের দুই মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এবং ‘অধিকার’ সহায়তা করেছে বলে জানিয়েছেন এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস। প্রতিবেদনটিতে বিডিআর বিদ্রোহের একটি বিস্তারিত বর্ণনাসহ সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের ওপর র‌্যাবসহ সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রামাণ্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ ‘সামরিক ট্রাইব্যুনাল’-এ এই বিদ্রোহ ও হত্যার বিচারকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট গণবিচার’ হিসেবে দেখিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘কুখ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এই নির্যাতনগুলোর অনেকগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।’’ অবিলম্বে এই বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত ও পক্ষপাতমুক্ত বিচার করার দাবি করেছে এইচআরডব্লিউ। একইসঙ্গে, মানবাধিকার লঙ্ঘন র্যাবের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে পুলিশের এ ব্যাটালিয়নটি বিলুপ্ত করার দাবি করে সংস্থাটি।

তথ্যদাতাদের হয়রানি  না করে সুরক্ষা দিতে এএইচআরসি’র আহবান
এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচে’র গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতাকারী বলে দেশের যেই মানবাধিকার কর্মীদের সন্দেহ করছে সরকার, তাদের খুব শিগগিরই গ্রেফতার করার সরকারি পরিকল্পনার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন।

শনিবার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এএইচআরসি বলে, “মানবাধিকার বিষয়ে প্রতিবেদন করা’র ক্ষমতা জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে দেয়া হয়েছে এবং জাতিংসঘের সব কর্তৃত্বশীল অঙ্গসংস্থা এ ক্ষমতাকে অবিরামভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্রেফ সেইসব মানবাধিকার সনদ ও ঘোষণার পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে আসছে-যেগুলো সম্মতি দিয়েছে রাষ্ট্রগুলো।’’

বিবৃতিতে বলা হয়, “এ বিষয়ে অবহিত ও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এএইচআরসি জানতে পেরেছে মানবাধিকার কর্মী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সংগঠকদের মধ্যে যারা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে তথ্য সরবরাহ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে আলোচনা করছে বাংলাদেশ সরকারের ভেতরে একটি মহল।”

হংকং ভিত্তিক এই আঞ্চলিক মানবাধিকার সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘কোনো ‘মানবাধিকার কর্মী বা সংস্থা’র ‘বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিতে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে বলছি।’’

অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল: ড. মিজান
প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বললেন, “বাইরের একটি মানবাধিকার সংস্থা র্যাবকে বিলুপ্ত করার যে প্রস্তাব করেছে এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। দেশে কোন সংস্থা থাকবে কোন সংস্থা বিলুপ্ত হবে তা বাইরের কেউ প্রস্তাব করতে পারেন না।”

বার্তা২৪ ডটনেট’র নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি হাসান মাহমুদ রিপন জানিয়েছেন, শনিবার দুপুরে মানবাধিকার আইনজীবী পরিষদের উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত ‘মানবাধিকার কমিশন ও নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার রক্ষায় একত্রে কাজ করার গুরুত্ব ও উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান।

ড. মিজানুর রহমান বলেন, “র্যাব বা অন্য কোনো বাহিনী থাকবে নাকি বিলুপ্ত করে দেয়া হবে এর সুপারিশ কোন বিদেশি সংস্থা বা সংগঠন আমাদেরকে করতে পারে না। তাদেরও জানা উচিত কত দূর পর্যন্ত তারা যেতে পারেন, কি সুপারিশ তারা করতে পারেন।”

বাংলাদেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সংস্থাটির এ ধরনের বক্তব্য’কে ‘মাত্রা অতিক্রম’ বলে মনে করেন তিনি।

বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়া সাংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: ‍সুলতানা কামাল
নারায়ণগঞ্জে একই অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের প্রধান সুলতানা কামাল বলেন, “র্যাবকে যে কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিল- তার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রেখেই র্যাবকে কাজ করতে দেওয়া উচিত। এখন আমরা দেখছি তারা তাদের কাজের বাইরে চলে গেছে।”

জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা আসক’র নির্বাহী পরিচালক সুলতানা বলেন, “আমরা র্যাবকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ বা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলিনি। আমরা বলেছি, র্যাবকে দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করতে দিতে হবে। র্যাব কিছু ক্ষেত্রে ভাল কাজ করেছে। সেই কাজগুলো তারা করে যেতে পারে।”

সুলতানা বলেন, “এক্ষেত্রে একই সঙ্গে ৪/৫শ’ জনের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হচ্ছে। একটি ঘরে উপস্থিত করে বিচার কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। যারা অভিযোগ আনছেন, তারাই ওকালতি করছেন, আবার তারাই রায় দিচ্ছেন। আমাদের বক্তব্য- এটি সাংবিধানিক নিয়মনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”

তিনি বলেন, “বিডিআরের ঘটনার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত, তবে তা ন্যায় বিচারের নিয়ম মেনে হতে হবে।’’

প্রতিবেদন প্রত্যাখানের সুযোগ নেই, র‌্যাব বিলুপ্তির প্রস্তাব যৌক্তিক: ড. শাহদীন মালিক
বিশিষ্ট আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বললেন, “বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার বিরোধ কর্মকাণ্ডের কারণে র্যাব বিলুপ্ত যে প্রস্তাব করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ- তা যৌক্তিক।”

একইসঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রসঙ্গে সংস্থাটির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যানের সুযোগ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে তা বলা যাবে না এটা ভাবা আরেকটা অন্যায়।’’ তাছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে একসাথে কাজ করে এমন সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করার সুরক্ষা দিতে সরকার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাধ্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বগুড়া সফররত ড. মালিক বার্তা২৪ ডটনেট’র প্রতিনিধি এফ শাজাহান’র সঙ্গে আলাপে বলেন, ‘‘র্যাবের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে যত দেরি হবে আমাদের ক্ষতিও তত বেশি হবে। একটা সভ্য দেশে এরকম পরিস্থিতি চলতে পারে না।” তিনি বলেন, ‘‘আরো আগেই র‌্যাব বিলুপ্ত করা দরকার ছিল।’’

বিডিআর বিদ্রোহে সন্দেহভাজনদের ‘পক্ষপাতদুষ্ট বিচার’ ও ‘নির্যাতন’-এর অভিযোগ করে মানবাধিকার সংস্থাটির প্রতিবেদন সমর্থন করে ড.শাহদীন মালিক বলেন, “এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করার কোনো সুযোগ নেই। এটা নির্যাতন বন্ধে সরকারের একটা দুর্বলতা।”

শনিবার বগুড়ায় মানবাধিকার সংগঠন ‘জাস্টিস বগুড়া’ আয়োজিত এক সেমিনার শেষে বার্তা২৪ ডটনেট’র সঙ্গে আলাপে তিনি এসব কথা বলেন।

No comments

Powered by Blogger.