আমাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ভাষা আন্দোলন by সেলিনা হোসেন

আমাদের সংস্কৃতিতে কী অভিঘাত এনেছিল একুশ? একুশে ফেব্রুয়ারিতে কী ঘটেছিল? প্রথমে আমরা তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। ঘটনাগুলো তো আমাদের সবারই জানা। পরিপ্রেক্ষিতও জানা। তবু তা একবার নতুন করে দেখা যাক।
১৯৪৭ সালে এই মহাদেশে ব্রিটিশ রাজের অবসান ঘটল। জন্ম হলো পাকিস্তান এবং ভারতের।


পাকিস্তান তৈরি হলো, কথিতভাবে, মুসলমানদের জন্য; অন্যদিকে ভারত ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের জন্য। আমরা, তৎকালীন বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়, পাকিস্তানকে সমর্থন করলাম। তার মানে, আমরা ধর্মকে প্রাধান্য দিলাম এবং একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য সৃষ্ট রাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলাম।
পাকিস্তানে প্রথম দিন থেকেই একনায়কত্ব স্থাপিত হলো, অন্যদিকে ভারতে প্রথম দিন থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। আমরা পাকিস্তানের একনায়কের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করলাম না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তিনি জোর গলায় বললেন, উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। আমরা কি সে সময় প্রকৃতপক্ষেই ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতিকে সর্বপ্রধান করে দেখেছিলাম? যদি দেখে থাকি, কেন দেখেছিলাম? ধর্মানুভূতির সঙ্গে একনায়কত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি আমরা সে সময় বিশেষ ধর্মানুভূতি দিয়ে আলোড়িত হয়েও থাকি, তা হলেও আমরা একনায়কত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলাম না কেন? এর কারণ কি এই যে আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত হয়নি অথবা গণতান্ত্রিক চেতনার চেয়ে ধর্মীয় আদর্শ ও অনুভূতিকে আমরা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছিলাম?
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন কেন? উর্দু পাকিস্তানের কোনো অংশেরই জনগণের মাতৃভাষা ছিল না। তবুও কেন? এর কারণ কি এই যে উর্দুর সঙ্গে একটি ইসলামী আবহ আছে? যেহেতু পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য গঠিত রাষ্ট্র, যেহেতু ইসলাম মুসলমানদের ধর্ম এবং উর্দু প্রধানত ভারতীয় মুসলমানদের ভাষা ও উর্দু আরবি হরফে লেখা হয়, সেহেতু যে ধর্মাবলম্বীদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি হলো, সেই ধর্মাবলম্বীদের ধর্মের সঙ্গে নৈকট্যের জন্যই কি উর্দুকে বেছে নেওয়া হলো?
যদি তাই হয়ে থাকে, আমরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিলাম না কেন? আমাদের ধর্মীয় আবেগ কি হঠাৎ করে বিলুপ্ত বা ক্ষীণ হয়ে গেল? যদি হয়ে থাকে, তা হলে তা কেন হলো এবং কেমন করে হলো? এ সবই সংস্কৃতির প্রশ্ন। এ প্রশ্নগুলোর সার্বিক উত্তর অনুসন্ধান করার মধ্য দিয়েই অমর একুশের পরবর্তী সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে সম্যকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
এই দেশে বহু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি বাস করেন। যে ধর্মেরই অনুসারী হন না কেন, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ, বলা যাক, বিপুলসংখ্যক মানুষ, ধর্মানুরাগী এবং ধর্মীয় আচরণ পালনে বিশেষভাবে যত্নশীল। এতদসত্ত্বেও আমি মনে করি না যে তারা ধর্মের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মভীরু ও ধর্মপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মান্ধ নয় এবং আগেও ছিল না_এ কথা আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই।
ধর্মের প্রতি অনুরাগের কারণে নয়, বরং এ দেশের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের প্রতি রায় দিয়েছিল, আমি মনে করি, অন্য একটি কারণে। তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল একটি ভীতি থেকে। আবার একই ভীতি থেকে তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকেও সমর্থন করেছিল। এই ভয়টি হলো সংখ্যালঘু হওয়ার ভয়। এ দেশের মানুষ পাকিস্তান চেয়েছিল অবিভক্ত ভারতে সংখ্যালঘু হয়ে থাকার চেয়ে বিভক্ত ভারতে সংখ্যাগুরু হয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে। আবার যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হলো, তখন এ দেশের মানুষ বুঝতে পারল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল না, তবু উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গে কিছু অভিজাত পরিবার ব্যতীত অন্যত্র এই ভাষা ব্যবহৃত হতো না। ইসলামের ভাষা আরবি, যেহেতু কোরআন শরিফ আরবিতে নাজিল হয়েছে, সে ভাষা দেশের কোনো জনগোষ্ঠীরই মাতৃভাষা নয়, কিন্তু ইসলামের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে, সে ভাষাকে বেছে নিতে চাইলে জিন্নাহ আরবি ভাষা বেছে নিত পারতেন, তা তিনি করলেন না। কেননা আরবি মুসলমানদের কমবেশি জানা থাকলেও তা এই উপমহাদেশের কোনো মুসলমান সম্প্রদায়ের মুখের ভাষা নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে। একসময় ছিল যখন সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হতো কিংবা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হতো। এ অবস্থা পৃথিবীর কোথাও কোথাও এখনো বিরাজমান থাকলেও অন্যত্র এর পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটেছে। সংখ্যালঘু হলেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হবে কিংবা কোনো না কোনোভাবে অসহায় জীবন যাপন করতে হবে, এটি পৃথিবীর বহু দেশে এখন আর সত্য নয়।
চলি্লশের দশকে পরিস্থিতি এখনকার মতো ছিল না। তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হতে আশঙ্কাগ্রস্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। তখন মানবাধিকার চেতনা এখনকার মতো প্রখর ছিল না এবং এখন মানবাধিকারের পক্ষে বিশ্বব্যাপী যে জনমত গড়ে উঠছে, তাও তখন অনুপস্থিত ছিল। এই ভূখণ্ডে গণতন্ত্রের চর্চাও ব্যাপক কিংবা দৃঢ়মূলে প্রোথিত ছিল না। সুতরাং তখন এ ভূখণ্ডের মানুষ যদি এমন একটি রাষ্ট্র চেয়েই থাকে, যেখানে তাদের প্রাধান্য হবে অবিসংবাদিত, হোক না সে রাষ্ট্র ধর্মের অলীক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং গণতন্ত্রের চর্চা ও এই উভয়ের জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা যে সংস্কৃতিকে কী গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করতে পারে, তা এ ভূখণ্ডের মানুষের পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট। যদি গণতন্ত্রের চর্চা অবাধ, ব্যাপক ও নির্বিঘ্ন হতো, যদি মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ধারণা শাসকগোষ্ঠী এবং জনগণ উভয়ের মনেই গভীরভাবে প্রোথিত থাকত, তাহলে সংখ্যালঘু হওয়ার যে আশঙ্কা এবং সংখ্যলঘু হয়ে অসহায় অবস্থায় পতিত হওয়ার যে ভয়, তা থাকত না। সে রকম পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালে এ ভূখণ্ডের মানুষের রাষ্ট্রজনিত সিদ্ধান্ত অন্য রকমও হতে পারত।
ব্যক্তিগত জীবনে জিন্নাহ একনিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন, এমন জানা যায় না। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিনই তিনি সে রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি ভেঙে দিতে চাইলেন, বললেন, এখন থেকে কেউ আর হিন্দু বা মুসলমান নয়, সবাই পাকিস্তানি। সন্দেহ হয়, ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য তিনি দ্বিজাতিতত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিলেন, যেমন বহু বছর পর ১৯৭০ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো একই দেশে একই সঙ্গে পার্লামেন্টে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ধারণা উদ্ভাবন করেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ও ব্যক্তিগত চিন্তায় জিন্নাহ যাই হোন না কেন, তিনি একটি ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ধর্মীয় উন্মাদনার অভিঘাত এখনো পর্যন্ত আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা অনুভব করতে পারি।
আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রাজনীতিবিদরা এবং ক্ষমতাসীনরা সংস্কৃতিকে যেভাবে দেখেন, সেভাবেই সংস্কৃতিকে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। আমাদের রাজনীতি আমাদের সংস্কৃতির চরিত্র নির্ধারণ করেনি। আমাদের সংস্কৃতিই আমাদের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারণ করেছে। সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে অমর একুশের জন্ম এবং অমর একুশ থেকেই স্বাধীনতার দিকে যাত্রা শুরু। রাজনীতি থেকে অমর একুশের জন্ম হয়নি। এই পার্থক্যটুকু যেন আমরা ভুলে না যাই। আমাদের সংস্কৃতির এই যে শক্তি, তা একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে উৎসারিত_এ কথা বলা ঠিক হবে না। আমাদের সংস্কৃতির শক্তি তার দৃঢ়মূলে প্রোথিত। এই সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের বলেই এবং বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে বলেই আমাদের সংস্কৃতি এই শক্তি অর্জন করতে পেরেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এই সংস্কৃতিকে আরো গভীর শেকড়ে প্রোথিত করে এবং একুশে ফেব্রুয়ারি তা করতে সক্ষম হয় বলেই তা একটি প্রতীকে পরিণত হয়। সরকারের সঙ্গে জনগণের বিরোধের এবং সে বিরোধের ফলে সরকারের শক্তির হাতে মানুষ নিহত হওয়ার আরো অসংখ্য ঘটনা এ ভূখণ্ডেই ঘটেছে। তার কোনোটিই একুশের মতো ব্যাপক এবং তীব্র আবেদন নয়, প্রতীকেও পরিণত হয়নি। এখানেই একুশের স্বাতন্ত্র্য, এখানেই একুশের শক্তি, এখানেই আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে একুশের নিবিড় যোগসূত্র।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.