আমরাও পারি, আমরাই পারব by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

কাজকর্ম সেরে দিন শেষে ঘরে ফিরে টিভি চ্যানেলে খবর দেখার অভ্যাস আমার অনেক দিনের। ক’দিন আগে একটি বিদেশী চ্যানেলে রিমোট ঘোরাতেই দেখলাম এক ভদ্রলোক বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে কি সব যেন বলছেন। ভারি নির্লিপ্ত তাঁর কথা বলার ভঙ্গি। ভদ্রলোক সাদা চামড়ার বিদেশী।


খেয়াল করে যেটুকু শুনলাম তাতে বোঝা গেল, বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। তাঁর বক্তব্যের দুটি বিষয় চমকে দেয়ার মতোই। একটি হলো, পিলখানায় সেনা অফিসার হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। দ্বিতীয়টি র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান বা র‌্যাব নামের প্রতিষ্ঠানটির বিলুপ্তি ঘটানো। কারণ র‌্যাব নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করে। উল্লেখ্য, এই ঘটনার দু’এক দিন আগে পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে মুখোমুখি গুলিবর্ষণে দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল ডাকাত শহীদ নিহত হয়। বিদেশী টিভি চ্যানেলে প্রচারিত খবর সম্পর্কে বিশদ জানতে একজন সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করে জানতে পারলাম হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামের একটি সংগঠন বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং সেখানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং র‌্যাব সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে, সাংবাদিক বন্ধু বিরক্তি ও রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ শুধু নয়, সংস্থাটি সম্পর্কে দ্রুত তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। প্রতিবাদ সঙ্গে সঙ্গে হয়েছে। সরকার, আইনমন্ত্রী, দায়িত্ববান রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ, র‌্যাবের পক্ষ থেকে এইচআরডব্লিউ-এর রিপোর্টকে মিথ্যা, কল্পনাপ্রসূত, বানোয়াট বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এইচআরডব্লিউ অধিকার বহির্ভূতভাবে নাক গলিয়েছে। সিনিয়র রাজনীতিকরা বলেছেন, রিপোর্টটি গভীর চক্রান্তের অংশ। কথাটি সত্য এবং এই ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনেও কোন সন্দেহ নেই। তার ভয়টা এখানেই যে চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসে শেখ হাসিনার উদারতার সুযোগ নিচ্ছে। এইচআরডব্লিউ সংস্থাটি আমেরিকার নিউইয়র্কভিত্তিক এবং তাদের অতীত কার্যকলাপ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরে বসে ইচ্ছামতো মনগড়া উপাত্তের ভিত্তিতে যথার্থ অনুমতি ছাড়া রিপোর্ট প্রকাশ করা রীতিমতো গর্হিত কাজ এবং তা বিচারযোগ্য অপরাধও বটে। তাছাড়া যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্থাটি অনাধিকার চর্চায় বাংলাদেশ এবং দেশের সরকারকে জ্ঞান দেবার চেষ্টা করেছে তা এখতিয়ারবহির্ভূত এবং সংস্থার চরিত্রের পরিপন্থী। মজার ব্যাপার হলো গত বুধবার এ রিপোর্ট প্রকাশ করার পর দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম কোন প্রকার বিচার বিশ্লেষণ এবং যাচাই না করেই তা ফলাওভাবে প্রচার শুরু করল। টেলিভিশনের টক-শোওয়ালাদের মুখে যেন তুবড়ি ছুটল। একবার তারা ভাবলেনও না যে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে শরিক হওয়া অপরাধ। তাঁরা বুঝলেন না যে, ‘চিলে কান নিয়ে গেছে’ শুনে চিলের পেছনে দৌড়ানো অজ্ঞতার লক্ষণ। গণতান্ত্রিক সরকারের দেয়া অগাধ স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে গণমাধ্যম এবং কতিপয় ব্যক্তির পাখা ঝাপটানো ব্যাপারটি আজকাল বড়ই দৃষ্টিকটু ঠেকছে। কয়েক সপ্তাহ আগে লিখেছিলাম, শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার গণমাধ্যম এবং মত প্রকাশের ব্যাপারে এতটাই স্বাধীনতা দিয়েছে যা অনেক উন্নত দেশে কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু একটা জিনিসতো সবার বোঝা দরকার যে, স্বাধীনতা পেয়ে ক্রমাগত মিথ্যাচার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা ঠিক নয়।
একই সঙ্গে এটাও বোঝা দরকার যে, দেশ ও জাতির ভাবমূর্তি নষ্টকারীদের দলে ময়ূরপুচ্ছ কাক হয়ে ভিড়তে যাওয়া বোকামি। অনেক সময় জ্ঞানপাপীদের কথাবার্তা, বডিল্যাংগুয়েজ থেকে মনে হয় দেশ, জাতি, সরকার, সরকার প্রধানের ওপর সাদা চামড়া ওয়ালাদের যুক্তিহীন আক্রমণে তারা খুশিই হন। ভাবখানা এমন যে আমাদের তো কিছু হয়নি। এই প্রসঙ্গে প্রাচীন এক গ্রামীণ গল্পের কথা মনে পড়ল। পুত্র গেছে পিতার সঙ্গে গরুর হাটে। গরু ব্যবসায়ীর টাকা চুরির সন্দেহে ধরা পড়লে হাটের মানুষ পিতাকে হাঁটুরে স্টাইলে উত্তম-মধ্যম দিল। পুত্র বাড়ি ফিরে তার সঙ্গে বলল, আল্লাহ্ মানির মান সম্মান রেখেছেন। টাকা চুরির সন্দেহে পিতাকে ধোলাই দিলেও তার গায়ে একটি আঁচড় লাগেনি। দেশের কতিপয় জ্ঞানপাপীর অবস্থা অনেকটা সেই রকম। দেশ জাতি রসাতলে যাক, তাদের গায়ে আচড় না লাগলে তারা নিে জকে নিরাপদ মনে করে। এই সুবিধাবাদী শ্রেণী একাত্তর, পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়া-এরশাদের কাল, জোট সরকারের আমল অর্থাৎ সকল সময় ভালই থাকে। স্থানীয় গণমাধ্যম এবং জ্ঞানপাপী সুশীলদের চোখে বোধহয় সুখবরগুলো গুরুত্ব পায় না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট প্রকাশের পাশাপাশি যে সুখবরগুলো গোচরে এসেছে সেগুলো নিয়ে বলতে গেলে কোন উচ্চবাচ্য নেই। যেমন ২০১১-১২ সালে প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠিয়েছেন ১২৮৪৬.০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগের বছরের তুলনায় যা এক হাজার মিলিয়নেরও বেশি। ২০১১ সালে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ২৪.৪২ শতাংশ। যার পরিমাণ প্রায় ১১৪ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় বাইশ কোটি ডলারের অধিক। এই তথ্য দিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সংক্ষেপে যার নাম আঙ্কটাড। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তুলনায় এই সংস্থাটির ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। এই শুভ খবরটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও চক্রান্তকারীরা এ ব্যাপারে নিশ্চুপই বলা যায়। তাই বার বার বলি, ইতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে কথা না বলে চক্রান্তকারীদের স্বভাব হচ্ছে নোংরা ঘেঁটে দুর্গন্ধ ছড়ানো। আর এ ব্যাপারে বারবারই আক্রান্ত হন শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার। এই যে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যক্তিগত সেলফোন নম্বর জানিয়ে দিলেন এবং নিয়মিত ফোন রিসিভ করছেন। এটা কি ছেলেখেলার মতো ব্যাপার? এটার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকমটি আগে কখনও ঘটেনি। অথচ বিষয়টি নিয়ে বলতে গেলে কথাবার্তাই নেই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকার প্রধানের সরাসরি যোগাযোগের এই দৃষ্টান্ত ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
ফিরে আসি এইচ আর ওয়াচের রিপোর্ট প্রসঙ্গে। গত বুধবার সংস্থাটির প্রতিনিধি মি. এ্যাডামস ‘ভয় আমাকে ছাড়ে না : ২০০৯-এর বিডিআর বিদ্রোহের পর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও পক্ষপাতদুষ্ট বিচার’ শীর্ষক রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। প্রথমেই বলতে হয় ২০০৯ সালের নৃশংস ঘটনাকে কি আদৌ বিডিআর বিদ্রোহ বলা উচিত? অবশ্যই নয়। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে পিলখানার বিডিআর হেড কোয়ার্টারে সাধারণ সৈনিকরা যে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে তা ছিল বর্বর হত্যাকা-, মোটেও তাকে বিদ্রোহ বলা যায় না। এই হত্যাকা-ের পেছনে ছিল দেশে গৃহযুদ্ধ বাধানো এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করা শেখ হাসিনাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র যদি সফলভাবে নস্যাত না করা যেত তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুই হতো না। বরং দেশটাকে জঙ্গীবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর খপ্পরে নিয়ে অকার্যকর করা হতো। এই নৃশংস হত্যাকা- এবং মানবতাবিরোধী অপকর্মের খবর এইচআর ওয়াচের রিপোর্টে গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার বিষয়টি। প্রথমত সেনা কর্মকর্তাদের যারা নৃশংসভাবে হত্যা করে কোনরকমভাবে মাটি চাপা দিয়েছিল কিংবা ড্রেন-ম্যানহোলে ফেলে দিয়েছিল তাদের বিচার দেখতে চায় দেশের প্রতিটি মানুষ। যে বর্বর পশুরা সেনা অফিসারদের স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে পশুর অধম নির্যাতন চালিয়েছে তাদের শাস্তি কামনা করে না এমন কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। ২০০৯-এর ২৫ ফেব্রুয়ারিতে পিলখানার বর্বরতাকে পাশ কাটিয়ে যারা বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অসত্য এবং মনগড়া তথ্যের রিপোর্ট প্রকাশ করে, বুঝতে হবে তাদের উদ্যোগের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য আছে। বিজেবি’র চলমান বিচার প্রক্রিয়া তো গণমাধ্যমে নিয়মিতই দেখানো হয়। খুবই ট্রান্সপারেন্ট সেটা। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং সকল ক্ষেত্রে তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগসহ সব ধরনের আইনানুগ সুবিধা পাচ্ছেন। এই তথ্যটি আজ কারও অজানা নয়। আর র‌্যাব কর্তৃক কারাবন্দীদের নির্যাতনের কথা যে বানোয়াট তার প্রমাণ হলো বিচার প্রক্রিয়ায় র‌্যাবের কোন প্রকার সম্পৃক্ততাই নেই। আসলে এইচআর ওয়াচের রিপোর্ট প্রকাশের পেছনে রয়েছে অন্য কোন গভীর উদ্দেশ্য। বিজেবি (প্রাক্তন বিডিআর) কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিবাদলিপিতে বলেছে, রিপোর্টটি উস্কানিমূলক এবং এটি দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। অতীতের কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এরকমটাই বিশ্বাস করতে হয়। আর সব কথার শেষ কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে নষ্ট করাই হচ্ছে এই ধরনের কুপ্রচেষ্টার উদ্দেশ্য। তাছাড়া মাত্র ক’দিন আগে আরাধ্য পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের ঠিক পরপরই এইচআর ওয়াচের অসত্য রিপোর্ট প্রকাশের পেছনে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির কথাও বলাবলি হচ্ছে। কিন্তু এই চাপ কিসের জন্য, কোন ফায়দা লাভের জন্য সেটাই জানতে চায় সাধারণ মানুষ। বিশ্বব্যাংক যে আমেরিকার সিদ্ধান্ত ছাড়া এক পাও নড়ে না সেটা সবারই জানা। এইচআই ওয়াচও আমেরিকাভিত্তিক সংস্থা। তাকে দিয়ে ঘুুঁটি চালনার পেছনেও কি কোন উদ্দেশ্য হাসিলের ব্যাপার আছে? হতেও পারে। তবে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নিজেরাই পদ্মা সেতু নির্মাণ করার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা সাধারণ মানুষ ভীষণ পছন্দ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যয়ের ভেতর লুকিয়ে আছে বাঙালীর সত্যিকার স্পিরিট। এই স্পিরিট আছে বলেই একাত্তরে আমরা যুদ্ধে জিতেছি। এই স্পিরিট আছে বলেই বারংবার আঘাতের পর বাঙালী জেগে ওঠে। এই স্পিরিট আছে বলেই বাঙালী অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। এই স্পিরিটের জোরেই ছিন্ন হবে সকল ষড়যন্ত্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হবে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুও তৈরি হবে। বাংলাদেশ এবং বাঙালীর সাফল্যে বিস্ময়ে তাকাবে গোটা বিশ্ব।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.