একটি মিথের মৃত্যু by সুভাষ সাহা

অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা উদারতা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণ হাত ধরাধরি করে চলে। পশ্চিমা চিন্তাবিদদের এই ধারণাটা দীর্ঘকাল ধরে প্র্যাকটিসের পর বিশ্বাসের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে মিথের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু চীন সেই মিথকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।


পশ্চিমা তাত্তি্বকদের ধারণা অনুযায়ী চীনে অর্থনৈতিক শনৈ শনৈ উন্নতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রচলিত গণতন্ত্রের বিকাশ যেমন ঘটেনি, তেমনি পশ্চিমা ধাঁচের উদারতাবাদ শুধু সরকারের কাছেই পরিত্যাজ্য নয়, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও তিয়েন আনমেন স্কয়ারের বিক্ষোভ দমনাভিযানের পর সে পথে যাওয়ার আগ্রহও তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এখন সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উন্নয়ন ভাবনাটাই বড়। প্রত্যেকে পড়ি কি মরি করে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল থাকার উপায় সাধনা করছে। চীনাদের কাছে পণ্য উৎপাদন কোনো ব্যাপারই নয়_ সেটা যে ধরনেরই হোক না কেন। তারা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো মানের একই পণ্য উৎপাদন করতে পারদর্শী।
চীনাদের এই অর্থনৈতিক উন্নতিকেন্দ্রিক ভাবনার সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা উদারতাবাদ কেন নাগরিক মানসে চাহিদা হিসেবে দেখা দিচ্ছে না সেটা নিয়েই পশ্চিমা চিন্তাবিদরা গভীর চিন্তায় মগ্ন। কেন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের মতো অর্থনৈতিক উন্নতিযোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধাতস্থ হচ্ছে না সেটাই তাদের চিন্তায় ফেলেছে। তাহলে কি ওই সরলীকৃত সমীকরণের বাইরে রাজনৈতিক রূপান্তর ছাড়াই উন্নয়ন মিরাকল সাধন করতে পারে, নাকি এর অন্য কোনো মাহাত্ম্য আছে!
চীনে এখন একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর এ ধরনের একটি পিরামিডের মতো স্ট্রাকচারসম্পন্ন সাত কোটি ৩০ লাখ সদস্যের বিশ্বের সর্ববৃহৎ পার্টির নিয়ন্ত্রণ ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সর্বত্র। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সময়ক্ষেপণের প্রয়োজন পড়ে না। এ ধরনের একটা আঁটোসাঁটো ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনে চীনের মতো একটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে যদি পহেলা নম্বরের শক্তি হয়ে ওঠে তাহলে তার সঙ্গে জিনে ওঠাও তো কঠিন। তদুপরি পশ্চিমা গণতন্ত্রের শাশ্বত ধারণাও ধাক্কা খাবে না! তখন আবার কমিউনিজমের ধারণা সমাধি থেকে জিন্দা হয়ে পুঁজিবাদী দুনিয়ার ঘুম হারাম করে দেবে না তো?
হ্যাঁ এটা ঠিক যে, চীনকে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অনেক কিছুই পাল্টাতে হচ্ছে। এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক ও কূটনীতির ভাষাও পাল্টে নিতে হচ্ছে। কিন্তু তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির তত্ত্বটা মৌলিকভাবে গ্রহণ করছে না। তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলারের একাধিপত্য খর্ব করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আফ্রিকি দেশগুলোকে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা তারা প্রায় সুদবিহীনভাবে এবং গ্রহীতা দেশের প্রকল্প নির্ধারণের স্বাধীনতা দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথ দেখাচ্ছে। চীনের এই বিপুল অঙ্কের অর্থ লগি্ন পুঁজিবাদের নীতি মেনে হয়নি। বরং স্বাধীনভাবে প্রকল্প বাছাইয়ের এখতিয়ার দিয়ে দেশগুলোকে নিজের দেশের প্রয়োজনীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা করছে। এ ছাড়া বিপুল অঙ্কের উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা নিজ দেশের গ্রামীণ ও দরিদ্র মানুষের উন্নতির জন্য ব্যয় করার ব্যবস্থা করে চীন তার নিজ দেশ থেকেও জ্যামিতিক হারে দারিদ্র্য দূর করার ব্যবস্থা করছে। চীনা নেতারা বলেছেন, তারা ভবিষ্যতে তাদের দেশে গণতান্ত্রিক উত্তর ঘটাবেন। তবে সেটা যে পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্র হবে না তা বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে কি ভবিষ্যৎ বিশ্বের পহেলা নম্বরের শক্তি চীন বিশ্ববাসীর সামনে গণতন্ত্রের নতুন কোনো মডেল নিয়ে উপস্থিত হবে, নাকি সেটা সমাজতন্ত্রেরই
রকমফের হবে!
 

No comments

Powered by Blogger.