বয়স্ক শিক্ষার প্রতি অবহেলা নয় by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

বয়স্ক শিক্ষার দিকটি বরাবরই আমাদের দেশে উপেক্ষিত; বিশেষ করে বয়স্কদের কোরআন ও দীনি শিক্ষার বিষয়টি। চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় দীনি শিক্ষার অনুপস্থিতিসহ নানাবিধ কারণে সমাজের অনেকেই দীনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ছোটদের জন্য মহল্লার মসজিদে বা মক্তবে কোরআন ও দীনি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বড়দের জন্য সে ব্যবস্থা অনুপস্থিত।


প্রবল আগ্রহ ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবে কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছেন না। কর্মজীবনের ব্যস্ততায় একটু লম্বা সময় নিয়ে তাবলিগে গিয়ে বা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে কোরআন ও দীনি শিক্ষাও সম্ভব নয়। তাই দরকার সমন্বিতভাবে কর্মজীবী ও বয়স্কদের জন্য কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে মসজিদের ইমাম-খতিব ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন। এই ব্যবস্থার ফলে সমাজে কোরআন শিক্ষার ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটবে।
কোরআন শিক্ষা ও শেখানোর বিষয়টি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ কাজ। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে_ হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত_ তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা বলতে পার কি, দানের দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা বড় দাতা কে? সাহাবাগণ উত্তর করলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (সা.) অধিক অবগত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, দানের দিক দিয়ে আল্লাহই হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা বড়। অতঃপর বনি আদমের মধ্যে আমিই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা। আর আমার পর বড় দাতা হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে ইলম শিক্ষা করবে এবং তার প্রচার-প্রসার করতে থাকবে। কিয়ামতের দিন সে একাই (দলবলসহ) একজন আমির অথবা (রাবির সন্দেহ) একটি উম্মত হয়ে উঠবে।_মিশকাত
অন্য আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত_ তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম ওই ব্যক্তি যে নিজে শেখে এবং অন্যকে তা শিক্ষা দেয়।_বুখারি
ইসলামের দৃষ্টিতে যে কোনো বয়সের প্রত্যেক নর-নারীর জন্য শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন ফরজ। সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষা। ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষের ৫টি মৌলিক চাহিদার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই অধিকারগুলো হচ্ছে_ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। মানুষের এই মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা হচ্ছে অন্যতম। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড।
শিক্ষা বিস্তারে আমাদের সমাজে সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা নানা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে বয়স্ক শিক্ষাও এর আওতাভুক্ত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নানামুখী ধারার ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম খুব একটা স্থান করে নিতে পারেনি। তাই শিক্ষাব্যবস্থার কোনো একটি ধারা সমাপ্ত করার পর অনেককেই দেখা যায় কোরআন ও ইসলাম শেখার জন্য গৃহশিক্ষক কিংবা মসজিদের ইমামের দ্বারস্থ হচ্ছেন। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যদি নূ্যনতম কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা থাকত তাহলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। আমরা জানি_ যে কোনো ধর্মের মানুষ যারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন, তারা সমাজে সৎ হন। তাই বলা যায়, ধর্মীয় শিক্ষাবিহীন শিক্ষা কখনও সুশিক্ষা হতে পারে না।
দক্ষ ও সুশিক্ষিত জনশক্তি দেশের সম্পদ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ইত্যাদি ক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নয়নের জন্য সমাজ থেকে ধর্মীয় নিরক্ষরতা দূর করা অত্যাবশ্যক। তবে নানা কারণে ধর্মীয় বয়স্ক শিক্ষা আন্দোলন এখনও আশানুরূপ অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি ও স্থানীয় উদ্যোগ আরও বিস্তৃত ও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় উন্নয়নের গতিবৃদ্ধির জন্য সার্বিক বয়স্ক ধর্মীয় শিক্ষা আন্দোলনকে গতিশীল করা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে ধর্মীয় নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধি করার বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ধর্মীয় শিক্ষায় সমাজ উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারণা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠান, র‌্যালি, আলোচনা সভা, সমাবেশ, শিক্ষামেলার আয়োজন, শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমানে দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে ৭৬৮টি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালু রয়েছে। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে সারাদেশে ১৯ হাজার ২০০ জন বয়স্ক লোক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, ইসলামী অনুশাসন, আদব-কায়দা, দোয়া-কালাম ও নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে এ প্রকল্পটি ইতিমধ্যে সারাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, পাঠাগার ও সমিতি-সংস্থা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বয়স্ক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছে। এসব শিক্ষাব্যবস্থাও সমাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এই ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত প্রস্তাবনা অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
ক. দেশের প্রতিটি কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসায় এক ঘণ্টার বয়স্ক শিক্ষা বিভাগ খোলা। প্রয়োজনে একাধিক ব্যাচ বা শিফটের ব্যবস্থা রাখা, যাতে আগ্রহীরা সুবিধামতো সময়ে অংশগ্রহণ করতে পারে।
খ. প্রতিটি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর এক ঘণ্টা সময় বয়স্কদের জন্য দীন ও কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
এখানে কোরআনুল কারিম শিক্ষাসহ নামাজ বিশুদ্ধকরণ, দোয়া-কালাম ও দীনিয়াতের অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় পড়ানো হবে।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.