গোলটেবিল বৈঠক-পাহাড়ধসে গণমৃত্যু ঠেকাতে কঠোর আইন চাই

পাহাড়ধসে গণমৃত্যু ঠেকাতে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দুর্বৃত্ত ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী তথা মধ্যস্বত্বভোগী, যারা পাহাড় দখল করে কেটে বসতি স্থাপন করছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বন্ধ করতে হবে পাহাড় বিক্রি।


আর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের রেলওয়ের কাছ থেকে জায়গা নিয়ে পুনর্বাসন করা যেতে পারে।
‘পাহাড়ধসে গণমৃত্যু: প্রতিকার ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে সোয়া একটা পর্যন্ত প্রথম আলোর উদ্যোগে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মিলনায়তনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলম, সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি মু. সিকান্দার খান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও পরিবেশবিদ শফিক হায়দার চৌধুরী, পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক মো. জাফর আলম, নগর পুলিশের উপকমিশনার (সদর) বনজ কুমার মজুমদার, নগর পরিকল্পনাবিদ বিধান বড়ুয়া, প্রকৌশলী আলী আশরাফ, চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ ও আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী আলোচনায় অংশ নেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। এর আগে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
সূচনা বক্তব্যে আব্দুল কাইয়ুম পাহাড়ধসে নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। এই দুর্দিনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান।
বৈঠকে আলোচকেরা বলেন, পাহাড় কাটার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ভূমিসন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তরা জড়িত। বিদ্যমান আইন দুর্বল বলে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এ জন্য কঠোর আইন করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা হলে পাহাড় কাটা কমে যাবে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী গরিব মানুষকে পুনর্বাসন এবং শহরমুখী স্রোত ঠেকাতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করার তাগিদ দেন বক্তারা।
পুনর্বাসন: আলোচনায় অংশ নিয়ে মেয়র মন্জুর আলম বলেন, পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা রোধের জন্য বসবাসকারী এক হাজার ৩০০ পরিবারের পুনর্বাসন জরুরি। এর স্থায়ী সমাধান হোক, সেটা সিটি করপোরেশন চায়। পাহাড়ের মালিক ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এখানে বেশির ভাগ পাহাড় রেলওয়ের। এ সংস্থা জমি দিলে পুনর্বাসনের বিষয়ে সিটি করপোরেশন চিন্তা করতে পারে।
সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী রেলওয়ের জায়গায় গরিব-ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেন। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন। তাঁদের পুনর্বাসন করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।
নগর পরিকল্পনাবিদ আলী আশরাফ পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ভোলা, হাতিয়া, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে বাস্তুহারা হয়ে গরিব লোকজন শহরের এসেছে। এখানে তাদের কোনো জায়গা নেই। তাই পাহাড়ের পাদদেশে সরকারি জায়গায় ঘর করে বসবাস করছে। ২০০৭ সালের দুর্যোগের পর তাদের পাহাড়ি এলাকা সরিয়ে কৈবল্যধাম ও ফতেয়াবাদে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ওই জায়গায় তারা থাকবে না। কারণ, তারা কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকতে চায়।
রেলওয়ের ২৫ একর জায়গার ওপর বহুতল ভবন করে গরিব মানুষের থাকার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন আলী আশরাফ। তিনি বলেন, একটি গরিব পরিবারের জন্য ১৫০ ফুট আয়তনের ফ্ল্যাট যথেষ্ট। ভবনের প্রতি তলায় গণগোসলখানা ও শৌচাগার এবং গণরান্নাঘর থাকতে হবে। এ ফ্ল্যাট বিক্রিযোগ্য না করে ভাড়াভিত্তিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম বলেন, ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্বাসনসহ অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা সুপারিশ করেছে। এগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে যে কথাটা বলা হচ্ছে, তার একমাত্র সমস্যা অর্থ। পাহাড় ব্যবস্থাপনা আমরা জানি, কিন্তু তা অনেক ব্যয়বহুল।’
মতৈক্যের মাধ্যমে সমাধানের তাগিদ: পুনর্বাসন বা উচ্ছেদ নিয়ে যাতে কোনো রাজনীতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথা উল্লেখ করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ সরকার যদি উচ্ছেদ করে তাহলে আরেক দল বলবে তাদের উচ্ছেদ করে দিয়েছে। এটা নিয়ে যাতে কোনো রাজনীতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
পাহাড় দখলকারীদের কোনো দলে আশ্রয় না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী। তিনি বলেন, দখলদাররা ক্ষমতা হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের চেহারা বদলে ফেলে। এটা যেন না হয়।
প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসীরা পাহাড় কাটে: মহিউদ্দিন চৌধুরী পাহাড় কাটার জন্য ভূমিসন্ত্রাসীদের দায়ী করেন। এদের ‘গরিব হত্যাকারী’ অভিহিত করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী, মাস্তান এসব ভূমিসন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করতে হবে। কারণ, এরাই পাহাড় কেটে পাদদেশে ঘর বানিয়ে গরিবদের বসবাসের সুযোগ করে দেয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী বলেন, পাহাড় কাটা হয় মাটি অন্যত্র ব্যবহারের জন্য। এরপর পাহাড়ের পাদদেশে কিছু গরিব লোককে দাওয়াত করে নিয়ে আসে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের কথা কেউ উল্লেখ করে না। পত্রিকায় তাদের নাম আসে না। এরা নিজেদের আর্থিক সুবিধার জন্য গরিব মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। গরিবেরা মনে করে, মধ্যস্বত্বভোগী এই লোকগুলো তাদের ত্রাণকর্তা। তাদের আইনের আওতায় আনতে পারলে পাহাড় কাটা রোধ করা সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ পাহাড় কাটার জন্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দায়ী করেন। বলেন, এই দুর্বৃত্তরা বস্তির লোকজনকে হুমকি-ধমকি দিয়ে পাহাড়ের নিচে বসবাস করতে বাধ্য করছে। আবার রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে বস্তির লোকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। পাহাড় কাটা রোধে সমন্বয়হীনতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে রেষারেষির কারণে সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে একের পর এক বস্তিবাসী ঘটনার শিকার হচ্ছে।
শহরমুখিতা বন্ধ করতে হবে: নগরে মানুষের আগমন ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে আরও বিপজ্জনক ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এমন আশঙ্কার কথা বললেন নগর পরিকল্পনাবিদ বিধান বড়ুয়া। তিনি স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়ে বলেন, গ্রামে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হলে গরিব মানুষ শহরমুখী হবে না।
অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা আমাদের দেশের উপকারে আসবে। প্রয়োজনে সামাজিক হাউজিং কোম্পানির মাধ্যমে লোকজনকে পুনর্বাসন করা যায় কি না, ভেবে দেখা যায়।’
শহরমুখিতা বেড়ে গেছে উল্লেখ করে জাফর আলম বলেন, এখন শহরে সাড়ে ৩১ শতাংশ মানুষ বাস করছে। দিন দিন এটা আরও বাড়ছে, যা ৫০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। শহরমুখিতা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
পাহাড় বিক্রি বন্ধ করতে হবে: পাহাড় বিক্রি ও কাটা বন্ধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, পাহাড়ধস রোধ করতে হলে প্রথমে পাহাড় বিক্রি বন্ধ করতে হবে। পাহাড় না কেটে, আইন মেনে পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপনা করা হলে কোনো সমস্যা হয় না উল্লেখ করে আবদুচ ছালাম আরও বলেন, পরির পাহাড়ে আদালত ভবন, ডিসি পাহাড়ে ডিসির বাংলো রয়েছে। ওসব পাহাড় কেউ দখল করছে না কিংবা কাটতেও যাচ্ছে না।
কঠোর আইন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি: আইনি দুর্বলতা ও আইনের ফাঁকফোকর পাহাড় দখল কিংবা কাটার অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন বক্তারা। নগর পুলিশের উপকমিশনার (সদর) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আইনে অনেক ধরনের ফাঁকফোকর রয়েছে। এ কারণে কারও সম্মিলিত ক্ষমতা নেই যে পাহাড় ঠিক রাখবে। তাই পাহাড় কাটা হচ্ছে ও তা ধসে পড়ছে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হলে শক্তিশালী আইন করতে হবে।
আইনি দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী বলেন, বিদ্যমান যে আইন রয়েছে তাতে প্রথমবার পাহাড় কাটার ক্ষেত্রে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এই ‘অথবা’ দিয়ে এটাকে দুর্বল করা হয়েছে। কারণ, যারা পাহাড় কাটছে, তারা প্রভাবশালী ও বিত্তশালী। তাই কারাদণ্ড এড়িয়ে তারা টাকা দিয়ে পার পেয়ে যায়। এ জন্য কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ জরুরি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক উদাহরণ দিয়ে বলেন, কিছুদিন আগে আকবর শাহ পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়েছিল রেলওয়ে। এর আগেই দখলদারেরা আদালতে গিয়ে উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। এ কারণে রেল কর্তৃপক্ষ আর উচ্ছেদ চালাতে পারেনি। পরে ওই পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
মু. সিকান্দার খান বলেন, ‘আমরা পাঁচ বছরের জন্য মেয়র নির্বাচন করি, সরকার নির্বাচন করি। জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি পালন করছেন কি না, তার জবাবদিহি আদায় করার জন্য নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দুই ভাগে বিভক্ত। দুই পক্ষকেই সচেতন করা সুশাসনের জন্য প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.