সাক্ষাৎকার-উন্নয়ন পরিকল্পনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে যুক্ত করতে হবে by আবুল হাসিব খান

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সুভাষ সাহা ও রানা আব্বাস দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কর্মরত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্কিং সংস্থা নিরাপদের চেয়ারপারসন, এফএমবির ভাইস চেয়ারম্যান আবুল হাসিব খান বর্তমানে রিকের নির্বাহী পরিচালক। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।


পিপলস হেলথ মুভমেন্ট বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নির্বাহী কমিটির সাবেক এই সদস্য অশোকা ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সিজিএপি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জনাব খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে ১৯৭৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার জন্ম ১৯৫৪ সালে
সমকাল : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্যোগের মাত্রা এবং তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ কী?
হাসিব :সম্প্রতি দুর্যোগের মাত্রা এবং তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুর্যোগ খুব ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে।
সমকাল : এ জন্য আমাদের কী ব্যবস্থা নিতে হবে?
হাসিব : দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হলে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্বপ্রথম যেটা করতে হবে তা হলো_ আমাদের একটা পরিপূর্ণ দুর্যোগ মানচিত্র তৈরি করতে হবে। জানতে হবে কোন অঞ্চলে কোন দুর্যোগ বেশি হয়। বন্যা কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে খুব একটা দেখা দেয় না, বন্যা দেখা যায় মূলত মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে। ঘূর্ণিঝড় হয় মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে। নদী ভাঙন দেখা যায় কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায়। টর্নেডো হয় মূলত দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে। অর্থাৎ কোন অঞ্চলে কোন দুর্যোগের প্রবণতা বেশি এটা ভালোভাবে জানার জন্য আমাদের একটি পরিপূর্ণ মানচিত্র প্রয়োজন। এরপর স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা জলবায়ু পরিবর্তন তথা দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে পারব না। আমাদের কাজ হবে দুর্যোগের সঙ্গে কীভাবে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানো যায়। যাতে করে আমরা দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারি। এ কারণে জাতীয় জীবনে যেমন দুর্যোগ পরিকল্পনা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও একই পরিকল্পনা প্রয়োজন। দুর্যোগ নিয়ে যারা কাজ করে এমন সংস্থা, স্থানীয় পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের জনগণকে এ পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে এবং বিভিন্ন সংগঠন, সমিতি, সংস্থাসহ সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
সমকাল : দুর্যোগে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
হাসিব : আগে আমাদের দেশে দুর্যোগকালে জনগণের সবাইকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হতো না। যেমন দুর্যোগের সময় প্রবীণ কিংবা প্রতিবন্ধীদের গুরুত্ব দেওয়া হতো না। অথচ দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, শিশু ও নারীরা। কারণ তাদের শারীরিক ও বুদ্ধিগত সক্ষমতা তুলনামূলক কম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের ওপর আমাদের একটা গবেষণা ছিল। গবেষণায় আমরা দেখেছিলাম, বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাড়ির সবাই আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যায় কিন্তু বাড়ির পাহারায় রেখে যায় প্রবীণদের। প্রবীণদের বাড়িতে রেখে যাওয়ার কারণ_ জনগণের ধারণা, প্রবীণদের বয়স হয়ে গেছে। তারা সবার আগে মারা যাবে। তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আর কী হবে। ব্যাপারটা কতটা নির্মম!
আশ্রয় কেন্দ্রে প্রবীণদের না নেওয়ার আর একটা নির্মম কারণ জেনেছিলাম মহেশখালীতে। এক প্রবীণ বলেছিলেন, '৯১ সালে অনেক কষ্টে আশ্রয় কেন্দ্র গিয়েছিলেন। কিন্তু এক যুবক তাকে আশ্রয় কেন্দ্রের দরজা থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। এর কারণ, প্রবীণদের বাথরুমে খুব ঘন ঘন যেতে হয় এবং তারা প্রকৃতির ডাকের চাপ সহ্য করতে পারে না। ফলে পায়খানা-প্রস্রাবে আশ্রয় কেন্দ্র নষ্ট করে ফেলার আশঙ্কায় তাকে সেখানে প্রবেশ করতে দিতে চায়নি ওই যুবক। এছাড়া অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে নারীরা, বিশেষ করে পর্দানসীনরাও আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চায় না। সঙ্গত কারণেই দুর্যোগের আগাম পরিকল্পনায় সবাইকে রাখতে হবে।
সমকাল : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্য...
হাসিব : আমাদের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে দুর্যোগ ত্রাণ কর্মকর্তাও রয়েছেন। কিন্তু এ কমিটিগুলো সক্রিয় নয়। এসব কমিটি যদি সক্রিয় হতো তাহলে তারা নিয়মিত জনগণকে সচেতন করত, ম্যাপিং করত, আশ্রয় কেন্দ্র চিহ্নিত ও উন্নত করত। এতে করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা অনেক উন্নত হতাম।
আমাদের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো আছে। এ ব্যুরোর কার্যক্রমও চোখে পড়ার মতো নয়। এটি সক্রিয় হয় কেবল দুর্যোগকালীন সময় অথবা দুর্যোগ হয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সারা বছরই আপনাকে এ প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। কিন্তু সেটা আমাদের দেশে করা হয় না। যখন দুর্যোগ থাকবে না তখনও দুর্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে। দুর্যোগ মনিটরিং, দুর্যোগ প্রস্তুতি, দুর্যোগ বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি, দুর্যোগের সঙ্গে কীভাবে খাপ খাইয়ে চলব, দুর্যোগের ঝুঁকি কীভাবে হ্রাস করব_ এসব বিষয়ে সারা বছরই আলোচনা করতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে, বলতে হবে, সচেতন করতে হবে। এ চলমান প্রক্রিয়াটিকে যদি আমরা স্থানীয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারি, কার্যকর করতে না পারি তাহলে কখনও দুর্যোগ ব্যস্থাপনায় উন্নতি করা সম্ভব নয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে সারা বছর সক্রিয় রাখতে হলে তহবিল প্রয়োজন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করবে তাদের সম্মানী দিতে হবে।
সমকাল : এবার বন্যা প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রতি বছর মৌসুমি বন্যার কারণে আমাদের ৩০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। বন্যার সঙ্গে আমরা কীভাবে খাপ খাইয়ে চলতে পারি?
হাসিব : আসলে আমরা ফি বছর দু'ধরনের বন্যা দেখে থাকি। এক. আকস্মিক বন্যা আর অন্যটি হচ্ছে মৌসুমি বন্যা। আকস্মিক বন্যায় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশি। হঠাৎ করে পাহাড়ের ঢল ভাসিয়ে দেয় ভাটি অঞ্চলকে। এটি মূলত আমাদের উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চল, বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে বেশি দেখা দেয়। আকস্মিক বন্যা কোথায় কোথায় বেশি হচ্ছে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে একটি ঝুঁকি-মানচিত্র তৈরি করতে পারলে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারলে এ দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই হ্রাস করা যেতে পারে।
আর মৌসুমি বন্যা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। যেমন কখন পানি বাড়বে, কখন কমবে_ এ ব্যাপারগুলো যদি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে মৌসুমি বন্যার সঙ্গে খুব সহজেই খাপ খাইয়ে চলা যায়। এছাড়া বাড়ির ভিটা উঁচু করা, ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি চিহ্নিত করা, দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বন্যা চলাকালীন সময় কী কী করতে হবে_ এগুলোর ব্যাপারে সারা বছরই প্রচার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি যদি সারা বছর সক্রিয় থাকত, তাহলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই হ্রাস পেত। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন। আসলে নানাভাবে যে পরিমাণ অর্থ আমরা নষ্ট করি তার সামান্য অংশ দিয়েই দুর্যোগ পূর্ববর্তী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি।
সমকাল : টর্নেডো প্রসঙ্গে বলুন।
হাসিব : টর্নেডো হঠাৎ করে হয়। আমাদের দেশে সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেই এটি বেশি হয়। টর্নেডোর সময় টিনের ঘরের মারাত্মক ক্ষতি হয়। টর্নেডোপ্রবণ অঞ্চলে ঘর তৈরির জন্য টিনের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো মেটেরিয়াল যদি সরবরাহ করা যায়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে আসতে পারে। আমরা পিরোজপুরে কিছু ঘর তৈরি করে দিয়েছি, যেগুলো ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার বেগের ঝড়ও কিছু করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে ঘর নির্মাণে সরকার সহজশর্তে ঋণ দিতে পারে।
সমকাল : মানুষকে সচেতন করতে আপনাদের পদক্ষেপ প্রসঙ্গে বলুন।
হাসিব : যারা দুর্যোগ নিয়ে ব্যাপক কাজ করছে এমন সংস্থা নিয়ে আমাদের একটি নেটওয়ার্ক আছে। এটির নাম 'ঘবঃড়িৎশ ভড়ৎ ওহভড়ৎসধঃরড়হ জবংঢ়ড়হংব ধহফ চৎবঢ়ধৎবফহবংং অপঃরারঃরবং ড়হ উরংধংঃবৎ ' বা 'নিরাপদ'। নিরাপদ দুর্যোগবিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোকে শিক্ষা, তথ্য, প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। নিরাপদ কাউকে তহবিল দেয় না। এটির মূল কার্যক্রম হচ্ছে দুর্যোগবিষয়ক অভিজ্ঞতা ও তথ্যবিনিময় করা। এ নেটওয়ার্কের কার্যক্রম মূলত দুর্যোগ-পূর্ববর্তী সময়কে কেন্দ্র করে। আমাদের সঙ্গে সরকারের অংশগ্রহণ যদি আরও বেশি হতো তাহলে এ নেটওয়ার্ক অনেক শক্তিশালী হতো। তাতে করে স্থানীয় পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী হতো।
সমকাল : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কী ধরনের?
হাসিব : আমাদের যে কোনো ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে। যেমন, কোথাও একটি বাঁধ নির্মাণ করতে হলে সেখানে দুর্যোগের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। কোথাও একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হলে সেখানেও অবশ্যই দুর্যোগের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। যদি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আমরা উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে না পারি, তাহলে আমাদের উন্নয়ন টেকসই হবে না। এতে করে ভবিষ্যতে দুর্যোগের সঙ্গে অভিযোজন বা অ্যাডাপ্ট করতে পারব না। দুর্যোগের কারণে দারিদ্র্যের 'পকেট' তৈরি হয়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উন্নত না করতে পারলে ভবিষ্যতে দারিদ্র্য বাড়বে। জনগণের একটি অংশ যারা অতিদরিদ্র অবস্থা থেকে যখনই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে, ঠিক তখনই দুর্যোগ আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে সব খুইয়ে তারা আশ্রয় নেয় শহরে। দেখবেন শহরের বেশিরভাগ ছিন্নমূল দরিদ্র মানুষই দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল থেকে আসা। নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ে সব খুইয়ে এসব মানুষ প্রতিনিয়ত শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। এতে করে শহরের ইনফরম্যাল সেক্টরের (যাদের স্থায়ী কোনো কর্মসংস্থান নেই) মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এতে নগরের নানা সমস্যা বাড়ছে। সব মিলিয়ে জাতীয় সমস্যা-সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। মাদক, ছিনতাই প্রভৃতি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পেছনেও এ বিষয়গুলো দায়ী।
সমকাল : জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে ...
হাসিব : কিছুদিন আগে দেখেছেন যশোরের অভয়নগরের ভবদহে কী তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল। ডিসির গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। সাতক্ষীরায় চার বছর ধরে জলাবদ্ধতা।
সমকাল : যশোর-সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা তো মানবসৃষ্ট।
হাসিব : হ্যাঁ, ওই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা মূলত মানবসৃষ্ট। নদীর ওপর যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আরেকটি জলাবদ্ধতা হলো নগরের জলাবদ্ধতা (আরবান ওয়াটারলগিং)। যেটি আমরা কয়েক দিন আগে চট্টগ্রামে দেখলাম। মাত্র একদিনের অতিবর্ষণে চট্টগ্রাম একদিনের জন্য পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল! দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪১ বছর পর এ ধরনের ব্যাপার ভাবা যায়! মূলত দক্ষতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এটি হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং অর্থনৈতিক গুরত্বপূর্ণ এ নগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল ছিল যে মাত্র একদিনের অতিবর্ষণেই চট্টগ্রাম পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
সমকাল : প্রতি বছর অতিবর্ষণে পাহাড়ধস হচ্ছে এবং তাতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।
হাসিব : একটা জিনিস খেয়াল করবেন, পাহাড়ে যারা মারা যাচ্ছে তারা বেশিরভাগই পাহাড়ি কিংবা আদিবাসী নয়। বাংলাদেশের অন্যান্য দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল থেকে যাওয়া মানুষ, যারা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে তারাই বেশি মারা গেছে। যারা পাহাড়ে প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করছে তারা জানে কীভাবে পাহাড়ে বাস করতে হয়। সে পাহাড়ের চরিত্র সহজেই বুঝতে পারে। কোথায় ধস হবে, কোথায় হবে না সেটা কিন্তু সে খুব ভালোভাবে বোঝে। কিন্তু যে ছিন্নমূল হিসেবে পাহাড়ে বাস করছে, সে তো পাহাড়ের চরিত্র এত ভালোভাবে বুঝবে না। আমাদের পাহাড় বালি মাটির তৈরি। তার ওপর যাচ্ছেতাইভাবে পাহাড় কাটার কারণে ধসে পড়ার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সমকাল : দেখা যায় অতিবর্ষণের সময় মাইকিং করেও তাদের পাহাড় থেকে নামিয়ে আনা যায় না। এ ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে?
হাসিব :যদি বিকল্প পুনর্বাসন করা না যায়, তবে সাময়িক আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে এমন আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। যাতে অতিবর্ষণের সময় তারা সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। এ সময় স্বেচ্ছাসেবকরা পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসরতদের আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে সহায়তা করবে।
সমকাল : ভূমিকম্প প্রসঙ্গে বলুন।
হাসিব : ১০০ বছর হয়ে গেছে আমাদের দেশে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। মাঝে মধ্যে মাঝারি, ছোট ছোট ভূমিকম্প ধাক্কা দিয়ে বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিচ্ছে। ভূমিকম্প নিয়ে এত সভা-সেমিনার হচ্ছে কিন্তু এ দুর্যোগ থেকে বাঁচতে সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে না। এ মুহূর্তে যদি মারাত্মক ভূমিকম্প হয় তাহলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কী পরিমাণ হবে তা কল্পনাই করা যায় না। ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিক মানুষ যতটা না মারা যাবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে ধুঁকে ধুঁকে। কারণ আমাদের উদ্ধারকরণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এখন একটি ভবন ধসে পড়লেই সেটির উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করতে লেগে যায় অনেক দিন। আর ভূমিকম্পে হাজার হাজার ভবন একসঙ্গে ধসে পড়লে সে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করতে কতদিন লাগবে তা হিসাব করে বলাও কঠিন। ঢাকা শহরে বেশিরভাগ ভবনই অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা এবং তাতে ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
তবে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতে হলে আমাদের শক্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে। গামবুট, গ্গ্নাভস, হেলমেট, মাস্ক ইত্যাদি জিনিসপত্র হাতের কাছে রাখতে হবে। মোদ্দাকথা, ভূমিকম্পের সময় ও পরে কী কী করণীয় তা জনসাধারণকে ভালোভাবে জানাতে হবে, প্রচার করতে হবে।
সমকাল : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্ট্রাকচারাল (কাঠামোগত) এবং নন-স্ট্রাকচারাল (অকাঠামোগত) কোনটির ওপর বেশি জোর দেবেন?
হাসিব : দুটিই জরুরি। তবে অল্প খরচেই নন-স্ট্রাকচারাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত করা যায়। এর জন্য শুধু দরকার সরকারের সদিচ্ছা এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে একটি কার্যকর সমন্বয়।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
হাসিব : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
 

No comments

Powered by Blogger.