কালরঙ্গ-দন্ত-তদন্ত প্রসঙ্গ by হিলাল ফয়েজী

২০১২ সালের পঞ্চম মাসজুড়ে পারিবারিক নানা উৎসব-কর্তব্যে বড়ই হন্তদন্ত জীবন কাটাতে হলো। সে উৎসবের লেজে গত ২৬ মে নিশি ১১টার দিকে কক্সবাজার থেকে ঢাকা আগমনের পথে আমাদের ভলভো বাসটি অন্য একটি বাসের সঙ্গে সম্মুখ সমর-ভালোবাসায় মুহূর্তে অন্যবিধ আঘাতসমেত এই হতভাগার সম্মুখের দুটি দন্তকে ভেঙেচুরে রক্তাক্ত করে দিল। আনন্দে বড় বেশি মত্ত ছিলাম।


দাঁতভাঙা জবাব দিলেন ঈশ্বর, পরমানন্দে প্রমত্ত হবি না হে ক্ষুদ্র মানব!
সেই দন্ত নিয়ে দন্তপণ্ডিতের তদন্ত-গবেষণা-পরিচর্যা চলছে। ফোকলাদেঁতো হয়ে কাল কাটাতে হবে আরো কিছুকাল। এই ফাঁকে কিঞ্চিৎ সমাজ-তদন্ত চলুক।
গত ২৬ মে রজনী ১১টার দিকে বিশাল শব্দে যখন দুটি বাসের তুলনামূলক রক্তস্বল্পতার সংঘর্ষ ঘটল জঙ্গলভরা দক্ষিণ চকোরিয়ায়, মুহূর্তে কোথা থেকে শত শত লোক জুটে গেল পরিবার-নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির দৃশ্যমান ব্যর্থতায়। দুটি বাসের কেউ হত হয়নি। আহত অনেকে। তবে মারাত্মক নয়। কিন্তু প্রবল আতঙ্ক, ডাকাতিপ্রবণ অকুস্থলের কারণে। সেখানে তিনটি ঘণ্টা কাটাতে হলো বিকল্প আয়োজনের প্রয়োজনে। তবে মিনিট দশেকের মধ্যে চলে এলো হাইওয়ে পুলিশ। আধা ঘণ্টার ভেতর উদ্ধার যান। রাস্তার পাশে একজন রিকশাচালক তাঁর বাড়িতে তাঁর হৃদয়ের সমুদ্র উজাড় করে বিপন্ন আমাদের ধারণ করলেন। গ্রামবাসী লাঠি নিয়ে আমাদের ঘেরাও করে নিরাপত্তা দিল। ১৯৭১ সালে যেমনটা পেয়েছিলাম ঢাকা শহর থেকে উদ্বাস্তু লাখো নগরবাসী বাংলার গাঁওগেরামে। কেউ নিহত হইনি, অতএব খবরটি প্রকাশিত-প্রচারিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করেনি কোনো মিডিয়ায়ই। তিন ঘণ্টার সুশাসনের এক টুকরো 'হীরক-উদাহরণ'-এর কথাটি কেউ কোথাও ভুলেও উচ্চারণ করবে না। একাত্তরের আতিথেয়তা দেওয়ার গ্রামবাঙালিদের আমরা মর্যাদা এবং সম্মান দিইনি। গত ২৬ মে মধ্যরাতের ওই গ্রামের ফেরেশতাসম মানুষগুলো এবং বিশেষত ওই রিকশাওয়ালাকেও কৃতজ্ঞতা জানানোর অবসর আমাদের কখনো হবে কি!
বিচূর্ণ দন্ত এবং বিধ্বস্ত চরণ নিয়ে ঘরে শুয়ে শুয়ে অমন কথা যখন ভাবছিলাম, তখন হঠাৎ দেখলাম স্বদেশভূমির শাসনব্যবস্থার দুটি দন্ত কেমন নড়বড়ে হয়ে পড়ল। জাতীয় সংসদ এবং সর্বোচ্চ আদালতের মধ্যে বাংলাদেশের এই চল্লিশ+ বছরের তীব্রতম দ্বন্দ্ব, বিব্রত-বিপর্যস্ত করে তুলল পরিস্থিতি। এই দ্বন্দ্ব উস্কে দেওয়ার উস্কানিদাতাও কম দেখা গেল না। রাষ্ট্র নিয়ে প্রকৃত উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যক্তিরা বরং অমানিশায় এক চিলতে আলো হয়ে মন ভরাল। অবশেষে সংসদ ও আদালতের দুটি দন্তই বুদ্ধি ও সুমতির পরিচর্যায় আপাতত কর্মক্ষম হলো।
মহাপ্রতিবেশী ভারতের শাসক এবং বিরোধী জোটেই দুটি প্রধান জাতীয় দল। এ দুটি দলকেই নির্ভর করতে হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর। আঞ্চলিক দলগুলোর দাপট বাড়ছে দিন দিন। জাতীয় দলগুলোর দন্ত ও নখড় জোর পাচ্ছে না আগের মতো। আঞ্চলিক দাঁত, আঞ্চলিক নখ কেমন ধারালো হয়ে উঠছে। সে দেশের সেনাদুর্গ জাতীয় সংসদকে সদা সম্মান দেখিয়ে এসেছে। ইদানীং সেই সেনাদুর্গেরও বোধ করি কাঁচা দাঁত গজাতে শুরু করেছে।
তবে পাকিস্তানের কাণ্ডকারবার একেবারেই আলাদা। জন্মের ৬৪টি বছরে ও দেশে কত যে গভর্নর জেনারেল, উজিরে আজম, সদরে রিয়াসত 'বরখাস্ত' হলো তার হদিস রাখাই বেশ জটিল ব্যাপার। ও দেশে জাতীয় সংসদ দন্ত গজায় গজায়, গজায় না। ও দেশের বিচার বিভাগ কখনো মিউ মিউ, কখনো হালুম হালুম। এখন তো বিচার বিভাগের দৃশ্যত শক্তপোক্ত দন্ত জাতীয় সংসদ আর নির্বাহী সরকারের দন্ত আর কর্ণের দফারফা করে দিচ্ছে। কে না জানে, ও দেশটিতে প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে জিন্নাকে ধীর বিষক্রিয়ায় হত্যা করা হয়েছিল ও দেশের জন্মের ঊষালগ্নেই। কিছুকালের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলীকে বুলেটে ফিনিশ করে দেওয়া হয়েছে। ও দেশের গ্লোবাল-চৌকস জুলফিকার ভুট্টো ফাঁসিতে লটকে অসহায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর ক্ষুরধার কন্যাটিকেও বধ করা হয়েছে প্রবল আক্রোশে। এসবের পেছনে রয়েছে ও দেশের ক্ষমতার প্রধানতম আক্কেল-দন্ত ওই 'আইএসআই' নামক সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরটি। ভারতের সামরিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান 'র' এবং অন্যগুলোর দাপটও কম নয়। তবুও সে দেশের সেনাদুর্গের চেয়ে পার্লামেন্ট এখনো সুনিশ্চিতভাবেই অনেক ধার ও ভারের। এদিকে বাংলাদেশের সেনাদুর্গ নেতৃত্ব সুযোগ পেলেই যে নানা কৌশলে আমাদের সিভিল নেতৃত্ব ও পার্লামেন্টকে বেকায়দায় ফেলে দুর্বল করে রাখতে চায়, সে খবরও তো কয়েক দশক ধরেই দেখছি। একজন জেনারেল ক্ষমতা হাতে নিয়ে এখানে একদা বলেছিলেন, আমি এ দেশের রাজনীতির পথ দুরূহ-দুর্গম করে দেব। সেই জেনারেল প্রাণে বাঁচেননি বটে; কিন্তু তাঁর ঘোষণাটি বৃথা যায়নি। এখনো তৃতীয় শক্তির 'জুজু' আমাদের রাজনীতিকে 'কুঁজো' করে রাখে সদা।
ব্যক্তিগত দুটো দন্ত হারিয়ে ঘরে শুয়ে শুয়ে ছাদ মেপে মেপে ক্ষমতার দন্ত-তদন্তের যে একটা হালকা ঝাপসা স্কেচ মাথায় এসেছে, তা দিয়েই আজকের কালরঙ্গ।
লেখক : রম্য লেখক

No comments

Powered by Blogger.