মন্তব্য প্রতিবেদন-বিশ্বব্যাংকের কোনো জবাবদিহি নেই! by টিটু দত্ত গুপ্ত

বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন ডাকসাইটে প্রেসিডেন্ট রবার্ট এস ম্যাকনামারা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সম্মানে রাষ্ট্রীয় ভোজসভা দেওয়ার প্রস্তাবে আপত্তি ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সে সময়ের ডেপুটি চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম তাঁর 'মেকিং অব অ্যা নেশন' বইতে


বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। গত রবিবার রাতে একটি টেলিভিশন টক শোতে প্রসঙ্গটির সূত্র ধরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক ক্যাবিনেট ও অর্থসচিব আকবর আলি খান বলেন, বিশ্বব্যাংকের আধিপত্য অস্বীকার করার জন্য নেতৃত্বের দৃঢ়তা দরকার। ম্যাকনামারাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে যাওয়ার প্রস্তাবেও রাজি হননি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য তখন ৩০০ কোটি (তিন বিলিয়ন) ডলারের প্রয়োজন ছিল। সেই নিঃস্ব অসহায় অবস্থায়ও যুদ্ধজয়ী স্বাধীন একটি দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজের ও দেশের মর্যাদার কথা মাথায় রেখেছিলেন তাজউদ্দীন।
৪০ বছর পর দেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। আর ততটাই পিছিয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মর্যাদাবোধ। নামসর্বস্ব গভর্নর হিসেবে প্রতিবছর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে হাজির হয়ে সাহায্যের জন্য হাত পাতা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীদের অন্যতম নির্ধারিত কাজ। দেশে ফিরে এসে অবশ্য প্রয়াত দুই অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলতেন, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিদেশে যেতে ভালো লাগে না। তবু এ কাজটি থেকে কোনো অর্থমন্ত্রীই বিরত থাকেননি।
অবসর গ্রহণের পর অর্থনৈতিক আমলারা টিভি টক শোতে যতটা জোরের সঙ্গে কথা বলে সহজে সব দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপিয়ে দেন, চাকরিতে থাকাকালে তাঁদের বেশির ভাগই 'নিয়মসিদ্ধ' ও 'বিধিবদ্ধ' কাজের বাইরে যাননি। সাবেক এক অর্থনৈতিক আমলা তাঁর ইআরডিতে (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির পক্ষে ইআরডিতে বেশি দিন কাজ করা সম্ভব নয়। এখানকার কাজ মূলত 'কোট-টাই পরে ভিক্ষা করা'। তাঁর আত্মগ্লানি ছিল। তবে অনেকের কাছেই ইআরডির চাকরি গৌরবের, সমৃদ্ধির। ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সান্নিধ্যে আসা যায়, চুক্তি সম্পাদনের নামে বিদেশে ঘোরা যায়, চাকরি থাকাকালীন ওয়াশিংটনে বা ম্যানিলায় পোস্টিং পাওয়া যায়, অবসর জীবনে কনসালট্যান্সির পথ প্রশস্ত হয়। বিশ্বব্যাংক বা এডিবির সদর দপ্তরে বিকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকেন চাকরিরত অর্থসচিবরাও। বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তাঁরা মূলত ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে সেখানে কাজ করেন।
বিশ্বব্যাংকে দুর্র্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে সম্প্রতি ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটির সদর দপ্তরে জি-হুজুরদের (ইয়েস ম্যান, ইয়েস ওম্যান) দৌরাত্ম্য, সেখানে ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। কথা বললে যদি নিজের দেশে ফেরত যেতে হয়, সে ভয়ে নানা অনিয়ম অসংগতি দেখেও চুপ করে থাকেন তাঁরা।
এসব অর্থনৈতিক আমলাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন দেশের অর্থনৈতিক নীতি। অবসরে যাওয়ার পরও তাঁরা সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে এ ধারণাই প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন যে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সহায়তা ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। এসব সংস্থাকে উপেক্ষা করলে বাংলাদেশ একঘরে হয়ে যাবে। এতে বিভ্রান্ত হন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাঁরা ভুলে যান, দেশের অর্থনীতির ভিত যে অনেক শক্ত, নির্মাণ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে, এখন বড় অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মতো সক্ষমতা বেসরকারি খাতেও সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ঘটা করে যে পদ্মা সেতুতে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করল, সেই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা প্রবাসীরা প্রতি মাসেই দেশে পাঠান। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে দেশের মানুষ গত অর্থবছরের চেয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি কর রাজস্ব দিয়েছে। এ দেশের বার্ষিক বাজেটের আকার এখন এক লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু তৈরির জন্য ২৩ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এ অর্থ যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই জোগাড় করা সম্ভব, সে কথা বিশিষ্টজনরা বারবারই বলছেন। তাঁরা বলে আসছেন, পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো তৈরির যোগ্য মেধা, প্রযুক্তি ও অর্থ দেশেই আছে। প্রয়োজন কেবল সাহসের। উপকরণ আমদানি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য প্রয়োজন মতো বিদেশি মুদ্রায় ঋণ সংগ্রহ করার কথাও বলেছেন।
একশ্রেণীর সুশীল মানুষও এসব সম্ভাবনার কথা হেসে উড়িয়ে দেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর 'উচ্ছিষ্টভোগী' বা 'আনুকূল্য প্রত্যাশী'। তাঁদের 'গেল গেল' রবে ভড়কে যান রাজনীতিবিদরা। সহায়তা ভিক্ষার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারেন না তাঁরা।
যে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি ডলার প্রত্যাহার করল, সেই একই পর্বে একটি চীনা কম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য মূল্যায়ন কমিটিকে অন্তত চারবার তদবির করেছিল বিশ্বব্যাংক। চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কম্পানি (সিআরসিসি) নামের সেই প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রের শর্ত পূরণ না করায় বাছাইয়ে বারবারই বাদ পড়ছিল। পরে প্রমাণ হয়, ড্রিলিংয়ের কাজে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকায় ওই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া দলিল দাখিল করা হয়েছিল। ওই কম্পানি নিজেই পরে দরপত্র প্রত্যাহার করে। এভাবে শুধু প্রাক-যোগ্যতা যাচাই করতেই এক বছর কেটে যাওয়ায় পরে বিশ্বব্যাংক গত বছরের ১ জুলাই মূল্যায়ন কমিটির বাছাই করা প্রাক-যোগ্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সম্মতি দেয়। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ও পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অবহিত করে। আর এর ৯ মাস পর ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিল বিশ্বব্যাংক। চীনা কম্পানিকে বাছাই পর্বে বাদ দেওয়ার পর থেকেই যে ৯ মাসের দুর্দশা শুরু তা অর্থমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দুর্নীতির নানা অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বারবার ঢাকা এসেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখেছেন। অথচ দুর্নীতির অভিযোগটি ঠিক কী, কার বিরুদ্ধে, কত টাকার লেনদেন হয়েছিল- এসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইনও কোনো দিন মুখ খোলেননি। তবে ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণাটি ছিল প্রকাশ্য। ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো সেই বিজ্ঞপ্তি ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস সরাসরি গণমাধ্যম কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার জন্য কেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনকেই বেছে নেওয়া হলো, সে ব্যাখ্যা বিশ্বব্যাংক দেয়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় সরকারের মন্ত্রী-আমলারাও বিস্মিত। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা এ সিদ্ধান্তকে অগ্রহণযোগ্য, অসম্মানজনক, খামখেয়ালিপনা বলে মন্তব্য করেছেন। অযোগ্য বিবেচিত চীনা কম্পানিটির জন্য বিশ্বব্যাংক কিভাবে চাপ দিয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ সোমবার অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দিয়েছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, প্রাক-যোগ্যতা যাচাই পর্বে কোনো দুর্র্নীতি হয়নি। দুর্নীতির অসমর্থিত অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পুরো জাতিকে অপমানিত করেছে। অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে এ অভিযোগ উত্থাপনের পরও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। বরং সংস্থাটির নতুন প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনে জানিয়েছেন, ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
যে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক নিজের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করল এবং পুরো ২৯০ কোটি ডলারের প্রকল্পটিকেই ঝুলিয়ে দিল, সে পর্বটি ছিল ছয় কোটি ডলারের পরামর্শক নিয়োগের কাজ। বাছাই করা পাঁচটি কম্পানির মধ্যে একটি পেত এ কাজ। ঘুষ সাধার দায়ে অভিযুক্ত কানাডিয়ান কম্পানি ছিল এর একটি। সেটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে ঋণচুক্তি কার্যকর ও প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছিল সরকার। বিশ্বব্যাংক তা শোনেনি। তাদের শর্ত মেনেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার বা সততা পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের অনুমোদন নিয়েই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল।
কারো প্রতিই আস্থা নেই এ সংস্থাটির। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে তাদের আস্থা নেই। তাদের দুর্নীতির অভিযোগের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে তিনটি শর্ত সরকার মানেনি বলে বিশ্বব্যাংক তাদের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে, সেগুলোতে রয়েছে সরকারি কাজে নিয়োজিত অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত ছুটি দেওয়া, দুদকের মধ্যে স্বাধীন একটি কমিটি গঠন করা ও তার কর্মকাণ্ডের তথ্য বিশ্বব্যাংককে জানানো। এগুলো মানা সম্ভব ছিল না বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত অপমানজনক বললেও অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে তা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন। বাংলাদেশও বিশ্বব্যাংকের সদস্য, তিনি নিজেও এ সংস্থাটির একজন গভর্নর। ১২০ কোটি ডলার ঋণের আশায় বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁর আর কী করার বাকি আছে! সব জবাবদিহিতা কি শুধু সদস্য দেশকেই করতে হবে? সদস্য দেশের কাছে বিশ্বব্যাংকের কি কোনো জবাবদিহিতা নেই?

No comments

Powered by Blogger.