সরকারের ৪২ মাস by আসিফ কবীর

৬ জুলাই বর্তমান সরকারের ৪২ মাস পূর্ণ হবে। এ বছর আমরা ৪২তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করেছি। এই ছয়-চতুর্থাংশ সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারের কর্মকাণ্ডের গতিধারা বিশ্লেষণ চেষ্টা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা এই সময়ে সরকারকে যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে দেখেছি, তার মূল্যায়ন করেই এ বিশ্লেষণ হতে পারে।


এ ক্ষেত্রে সরকারের কাজের বা মনস্তত্ত্বের কার্যকারণ অনুসন্ধানও প্রাসঙ্গিক হবে।
চরম ও দীর্ঘস্থায়ী মন্দাকালীন ক্ষমতায় এসে বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা করতে হয় বর্তমান সরকারকে। গত বছরের শেষদিকে অভ্যুত্থান চেষ্টা, শেয়ারবাজারে মন্দাভাব, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি, পর পর সড়ক দুর্ঘটনায় সেলিব্রিটি ও মিডিয়াকর্মীর মৃত্যু, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে উপজীব্য করে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় বেপরোয়া লাভের অনুশীলন ইত্যাদি বিষয় সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয়।
ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সুযোগ-সুবিধা বিনিময়ের সব ইস্যুতে সমান সফল না হতে পারা সরকারকে শীর্ষ শিরোপাজয়ী করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাদানে সরকারকে ব্যর্থ সাব্যস্ত করতে নিরন্তর ষড়যন্ত্র অব্যাহত। ফেসবুক, ইন্টারনেটের অপপ্রচার এর অকাট্য প্রমাণ। বিরোধী দলের অসহযোগিতা, অপপ্রচার, নাশকতা তো নিত্যসঙ্গী। সরকারের লোকদের মিডিয়ায় প্রচার-কাতরতায় অসম্পূর্ণ ও প্রস্তুতিহীন বক্তব্য প্রদান কখনো কখনো বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অমনীষীসুলভ কর্মকাণ্ড সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলছে।
এতদসত্ত্বেও ৭ জুন তিন বছরের সংগতিপূর্ণ ধারাবাহিকতার জাতীয় বাজেট ঘোষণা হয়। ২৮ জুন বাজেট পাস হয়। সরকার তার রুটিন কাজগুলোয় প্রায়োগিকতা বাড়িয়ে এবং উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণী কাজগুলো জোরেশোরে করে যাচ্ছে।
নাগরিক সমস্যা নিয়ে আজকাল সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা ও আলোচনায় খোলামেলা কথা হয়। পক্ষান্তরে সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় তার মূলকথা হলো যেভাবে নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জকভাবে সরকারের অর্জনগুলোকে নাকচ করা হয়, সেটা বাস্তবতাবিবর্জিত ও দুঃখজনক। পরিবর্তিত মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মানুষ ও মানুষের চাহিদা বৃদ্ধিতে সমস্যাগুলোর সর্বব্যাপী সমাধান সম্ভব হয়নি সত্য, কিন্তু যা করা হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য। লক্ষণীয় যে সর্বাংশে সরকারের সমালোচনামুখর টকশোতেও তিনটি কথা শোনা যায় না। তা হলো- ১. যা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পূর্ণাঙ্গভাবে পূরণ করতে পারেনি, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এসে করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত; ২. সরকারের অসাফল্যের বিপরীতে ভবিষ্যতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা দাবি এবং ৩. (পূরণীয় না হোক তবু) কী পদক্ষেপ নিলে স্বল্পমেয়াদি ও স্থায়ী ভিত্তিতে বর্তমান সরকারের সাফল্য সর্বব্যাপী হবে।
বর্তমান সরকারের সমুদয় বিবেচনায় মনে রাখতে হবে মানুষের মনে তাদের নিয়ে যে ব্যাপক প্রত্যাশা, তা সংগত। এ প্রত্যাশা পূরণের দায় ও সামর্থ্য আছে তাদেরই। অতএব টকশোতে উত্থাপিত নাগরিক সমস্যাগুলোর বিস্তৃতি কমানোর মহাচ্যালেঞ্জ নিলে দেশসেবার সঙ্গে তাদের অবধারিত রাজনৈতিক লাভও হবে।
সরকারের মনস্তত্ত্বের একটি যুক্তিনির্ভর আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। গত রোজার ঈদের আগে একযোগে দাবি উঠল তদানীন্তন যোগাযোগমন্ত্রীর পরিবর্তন চাই। ঈদের আগে বাড়িমুখো মানুষের নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছানো নিশ্চিত করতে সে মুহূর্তে মন্ত্রী বদল কি খুব যুক্তিযুক্ত ছিল? একজন মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে কাজে যোগদান, যোগদানকালীন লোকাচার রক্ষা এবং কাজে নামতেও তো সময় লাগে। নাকি বাস্তবসম্মত হলো ওই পুরনো জনকেই সতর্ক করে জরুরিটা সামাল দেওয়া? সরকার বাস্তবানুগটাই করেছিল। তারপর মন্ত্রী বদল হলো ২০১১-এর শেষে। তখন মন্ত্রী বদলের জন্য যাঁরা যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন তাঁরা বললেন- ১. দেরিতে হলেও সরকার মানল; ২. কেউ বললেন, সরকার চাপে বাধ্য হয়েছে এবং ৩. কেউবা মন্ত্রণালয়ের কাজে অস্বচ্ছতার পরোক্ষ স্বীকারোক্তি হিসেবে এই পরিবর্তনকে বিবৃত করলেন। সরকারের সব কাজেই অমন খুঁত, নেতি এবং বদনাম বের করার রেওয়াজ হলে তার ইচ্ছাশক্তি মার তো খেয়ে যাবেই।
অনেক বিষয়কে আমাদের অবস্থাসাপেক্ষ বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে। রাজনীতিকরা দল বদলে ভিন্নতর কথা বলেন। রাজনৈতিক দলও সরকারে ও বিরোধী দলে অবস্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে। যেমন- সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের নেতারা আজ যে কথা বলছেন, তাঁরাই কেউ কেউ ২০০৯ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলে বা জয়ী হয়ে মন্ত্রিত্ব পেলে এমন কথা কি বলতেন? যেকোনো সম্পর্ক বা বন্ধনের সর্বশেষ অবস্থা দিয়েই সব বিচার্য বা চালিত হয় সত্য। তবু রাজনৈতিক অবস্থান সাপেক্ষে দেওয়া বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতাকে শূন্যের কোটায় নিয়ে যায়। এতে যার বিরুদ্ধে সমালোচনা, সে সংশয়ের সুবিধা পেয়ে যায়। সমালোচনা বিলাপ হয়ে দাঁড়ায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যখন শুরু হয়েছে সে মুহূর্তে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এমন আচরণ, কথা বা গণমাধ্যমে নিয়মিত টকশো করছেন, যা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংশয়ের সুবিধায় আইনকে ফাঁকি দেওয়ার অযাচিত সুযোগ করে দিতে পারে। অন্যদিকে প্রগতিশীল কলাম লেখক এবং মহাজোটের বাইরের রাজনৈতিক ঋদ্ধিবান বাম দলগুলো কায়মনোবাক্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান; কিন্তু বিচারের উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে জোরালো সমর্থন জোগান না। তাঁরা আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা করেন, কিন্তু এ জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত বা সামর্থ্যবান করে তোলেন না। এতে রাজনীতি এমন হয়ে উঠছে যে নেতা বা প্রার্থী বাছাইয়ের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড এখন শত বৈরী অবস্থায় শেষমেশ কে টিকতে পারবে, সেটাই।
স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বকারী আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদকালের ৪২-এ টেকসই অর্থনৈতিক বুনিয়াদ; বাংলা ভাষা, বাংলাদেশি ক্রিকেট দল, জাতিসংঘে নিযুক্ত শান্তিরক্ষী বাহিনী, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, প্রবৃদ্ধি অর্জনের মডেল প্রভৃতির আন্তর্জাতিক উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া, খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা তথা কৃষি খাতে অভাবনীয় বিপ্লব, প্রবাসী বাঙালিদের নানা সাফল্য ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান, গার্মেন্ট ও রপ্তানি খাতে ক্রমবর্ধিষ্ণু অর্জন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসরমাণতা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বিকাশ, শিক্ষার প্রসার ও মেধাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে ঈর্ষণীয় সাফল্য, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শ্লাঘনীয় অর্জন, স্বাধীন মত প্রকাশের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে জয়লাভ করে আমাদের সমুদ্রসীমা ও সম্পদের মালিকানা প্রাপ্ত হয়েছি। তথাপি আজও অনেকে পাকিস্তানি আমল ও বাংলাদেশ আমলের সামরিক শাসন নিয়ে নস্টালজিক হন। তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত সুযোগে দায়হীন অনেক প্রচারণা দেখি। দেশ নিয়ে বেশি ভাবনার সময়শূন্য তরুণরা এসব প্রপাগান্ডায় প্রভাবিতও হন। তাঁদের সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার স্বার্থে বলি, গণতন্ত্রের যেমন দুর্বলতা থাকে স্বাধীনতারও থাকে। স্বাধীনতার এ দুর্বলতার জন্যই দায়িত্বহীন অপপ্রচার প্রাযুক্তিক উৎকর্ষে এখন রশ্মিগতিতে ছড়ানো যায়। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও মর্যাদাশালী বলেই সব কিছুতেই অবলীলাক্রমে বহুমাত্রিকতার নিত্য উপস্থিতি।
পুনশ্চ : রাত জেগে টকশো দেখে আমরা (আমাদের মতাদর্শ ভেদে) যাঁদের বক্তব্যে নিজেদের মনের কথা খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস পাই, তাঁরাও একটিবারও বলেন না, দুই বছরের অনির্বাচিত সরকার সরাসরি সম্প্রচারিত আলোচনামূলক অনুষ্ঠান তথা টকশো নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। তখন মন খোলা কথা বলা বা মতামত প্রকাশের সুযোগ ছিল সীমিত ও ঝুঁকিবহুল।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.