কালান্তরের কড়চা-পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক নেপথ্যের খেলা-২ by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

ঢাকার মতো লন্ডনে কাকডাকা ভোর নেই। কাকই চোখে পড়ে না, তারপর তার ডাক! তবে সামারে হঠাৎ দু-একটা কাক দেখা যায় এবং তার ডাকও শোনা যায়। আজ ভোরে ঘুম ভেঙেছে কাকের ডাকে। প্রথমে মনে হয়েছিল, ঢাকাতেই বুঝি আছি। চোখ মেলে ভ্রম ভাঙল, না লন্ডনেই আছি। তবে কাকডাকা ভোর।


নিবন্ধটির দ্বিতীয় অংশ লিখতে বসে মনে পড়ল, আজ ৩ জুলাই, মঙ্গলবার। পাঠকরা আমার এই লেখাটি পড়বেন ৪ জুলাই, বুধবার। ১৭৫৭ সালের এই ৩ জুলাই তারিখে পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব সিরাজকে হত্যা করা হয়েছিল। সুবেবাংলার স্বাধীনতা অপহৃত হয়েছিল। এই স্বাধীনতা অপহরণের চক্রান্তে যুক্ত হয়েছিলেন সেনাপতি মীর জাফর ও তাঁর সেনাবাহিনী, তখনকার বাংলার নব্য ধনী জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ। পেছনে শক্তি ও সাহায্য জুগিয়েছে তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি।
আজ ২৫৫ বছর পর ৩ জুলাই তারিখে এই নিবন্ধটি লিখতে বসে মনে প্রশ্ন জাগল, আমরা কি আবার একই পরিস্থিতির সম্মুখীন? প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে এবার যারা ঘোঁট পাকাচ্ছে, তাদের প্রধান অংশ বাংলাদেশের নব্য ধনী, নতুন জগৎ শেঠরা ও তাদের পেছনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী বিশ্বব্যাংক, সঙ্গে সহযোগী কয়েকটি পশ্চিমা দাতা দেশ। তখন সিরাজবিরোধী চক্রান্তে খলনায়িকার ভূমিকা নিয়েছিলেন ঘসেটি বেগম। এই শতকেও বাংলাদেশের চক্রান্তের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছেন ঘসেটি বেগমের মতো আরেক খলনায়িকা।
তবে ২৫৫ বছরের ব্যবধানে এই দুই চক্রান্তের মধ্যে একটাই পার্থক্য এবং তা হলো, সিরাজদ্দৌলার আমলে মিডিয়া ছিল না এবং সুশীল সমাজ নামধারী গণস্বার্থবিরোধী, সুবিধাভোগী একটি প্রতারক চক্রও ছিল না। এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশে আবারও কি ২৫৫ বছর আগের ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব হবে? আমার একান্ত আশা ও প্রার্থনা, তা সম্ভব হবে না। সেই বিখ্যাত মনীষী বাক্যটি এখানে স্মর্তব্য �History repeats itself. First it repeats in tragedy, then it repeats in farce� (ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। প্রথমে এই পুনরাবৃত্তি বিয়োগান্ত ঘটনায়, তারপর তামাশায়)।
আমার ধারণা, ২০১২ সালে বাংলাদেশকে নিয়ে যে চক্রান্ত এই জুন-জুলাই মাসে নতুনভাবে দানা বেঁধে উঠেছে, এবার তার পরিণতি ঘটবে প্রহসনে বা তামাশায়। ১৭৫৭ সালের চেয়ে বাংলার গণমানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন এবং চক্রান্তকারীদের নেতাদের, তাঁদের বাদ্যবাদক তথাকথিত দুটি নিরপেক্ষ মিডিয়ার, নব্য ধনী ও সুশীল সমাজের অনেকের, নতুন জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফদের এবং সর্বোপরি তাঁদের পেছনের মদদদাতা বিদেশি বিভীষণদের আসল চেহারা এখন বাংলার মানুষের কাছে অনেক বেশি স্পষ্ট।
হাসিনা সরকার যদি সাহস না হারায়, ভুল না করে, তাহলে এবারের চক্রান্তকারীরা যত শক্তিশালী হোক, তাদের চক্রান্ত প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত তদন্তটি যদি সরকার সাহসের সঙ্গে চালিয়ে যায়, তাহলে ফতুয়াধারী নতুন জগৎ শেঠদের অনেক কীর্তিকলাপ ফাঁস হয়ে যাবে। তাই এই তদন্ত বন্ধ করার জন্যও তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমার ধারণা, শুধু ধারণা নয় বিশ্বাসও, বর্তমান হাসিনা সরকারের ভাগ্য নির্ভর করছে দুটি ব্যাপারে তাদের সাহস ও আন্তরিকতার ওপর। এই দুটি ব্যাপারের একটি হলো, ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং অন্যটি হলো গ্রামীণ ব্যাংকের গত তিন দশকের বেশি সময়ের কার্যকলাপ সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্তটি চালিয়ে যাওয়া। দুটি ব্যাপারেই ভয় পেয়ে পিছু হটলে দারুণ বিপদ আছে।
আগেই বলেছি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করা একটি অজুহাত ও ভাঁওতাবাজি। বিশ্বব্যাংকের নিজের শরীরে দুর্নীতির ঘা দগদগ করছে। তাদের সাবেক প্রেসিডেন্টকে নারীঘটিত কেলেঙ্কারির অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছে, বিচারের সম্মুখীন হয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছে। এখন সেই চালুনি বলছে- সুচ, তোর কেন এত বড় ফুটো? আসলে বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সরকার ও দেশটির বিরুদ্ধে চক্রান্ত। পদ্মা সেতু নির্মিত না হলে ক্ষতিটা শুধু আওয়ামী লীগ দল বা সরকারের নয়, ক্ষতিটা সারা দেশের।
আমাদের দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী (কুবুদ্ধিজীবী), মিডিয়া ও রাজনীতিক সম্পূর্ণভাবে দেশপ্রেমবর্জিত না হলে এই সম্ভাব্য জাতীয় ক্ষতিকে কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষতি ভেবে এতটা উল্লসিত হতে পারতেন না। বরং গোটা দেশের বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত রুখে দাঁড়ানোর জন্য একাট্টা হতেন। জাতির ক্ষতিকে একটা দল বা সরকারের ক্ষতি হলো বলে আনন্দে বগল বাজাতে পারতেন না।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, বর্তমান সরকার ড. ইউনূসের ওপর একটা অন্যায় করেছে, তা হলেও এই অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য দেশের ভেতরেই আন্দোলন, প্রতিবাদ ইত্যাদি নানা পথ তো খোলা আছে। তা না করে অথবা জনসমর্থনের অভাবে তা না করতে পেরে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নগ্ন বিদেশি হস্তক্ষেপ ডেকে আনতে হবে? এক ব্যক্তির স্বার্থ গোটা দেশের স্বার্থের ওপর স্থান পেতে পারে?
এখন পর্যন্ত অপ্রমাণিত দুর্নীতির অভিযোগে বা অজুহাতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর অর্থায়নে অসম্মতি জানানোয় আনন্দে বিএনপি নেতা-নেত্রীদের ঘুম হচ্ছে না। তাঁদের প্রচারণা হচ্ছে, 'বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগে সারা জাতির মুখে কলঙ্ক লেপিত হয়েছে।' আহা, বিএনপি কি সতী সাধ্বী রে! তারা ভুলে গেছে, তাদের সরকারের আমলেই তাদের নৌপরিবহনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাতা দেশ ডেনমার্ক গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাদের সাহায্য স্থগিত অথবা প্রত্যাহারের কথা বলেছিল। বিএনপিনেত্রী ও তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করা দূরের কথা, তাঁর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন এবং দাতা দেশটির প্রতিনিধি সম্পর্কেই কটুকাটব্য করেছিলেন। তখন একটি নয়, গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচ-ছয়টি আন্তর্জাতিক সাহায্য স্থগিত অথবা বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
তখন জাতির মুখে কলঙ্কের কালি লেপিত হয়নি। বিএনপিনেত্রীর সুপুত্র বিদেশি আদালতে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ পাচারের দায়ে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হলেও বিএনপির নেতারা লজ্জা পা ননা, বরং 'চোরের মায়ের বড় গলা' প্রবাদটি তাঁরা সঠিক প্রমাণ করেন, আর এখন দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই (যার তদন্ত চলছে) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপরায়ণ হয়ে বিশ্বব্যাংক গোটা দেশের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত করছে, তাতে নাকি জাতির মুখে কলঙ্ক লেপিত হয়েছে! বিএনপির অভিধানে কলঙ্ক শব্দটির অর্থ কী তা জানতে ইচ্ছে করে।
এখন হাসিনা সরকারের সামনে সংকট উত্তরণের দুটি পথ খোলা আছে। এক, জাতীয় মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার অন্যায় ও অশুভ চাপের কাছে মাথা নত করে আবার পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য দেনদরবার করা। এ ব্যাপারে রিজভী অ্যান্ড কম্পানি আর কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। হাসিনা সরকারকে নতুন চ্যানেল খুঁজতে হবে। ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক ফিরিয়ে দিলে তিনিও হয়তো হাসিনা সরকারকে বিব্রত করার (এমনকি উচ্ছেদ করার) ক্যাম্পেইন থেকে বিরত হতে পারেন।
এ ব্যাপারে হাসিনা সরকারের সামনে দ্বিতীয় পথটি হলো, জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য আপৎকালীন দৃঢ়তা নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং দেশি-বিদেশি বিকল্প সূত্র থেকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছেন, এভাবে অর্থ সংগ্রহ সম্ভব। দরকার সরকারের দৃঢ়তা ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দক্ষতা। সরকার এই অর্থ সংগ্রহে দৃঢ়তা ও দক্ষতা দেখাতে পারলে এই সেতু সম্পর্কে জাতি আশ্বস্ত হবে। বিএনপি ও তাদের অনুগৃহীত বুদ্ধিজীবীদের গোঁফের নিচের হাসি মিলিয়ে যাবে। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে নোবেলজয়ীর বিশ্ব-ক্যাম্পেইন ব্যর্থ হবে। বিশ্বব্যাংকের অসাধু চাপ অকার্যকর হবে এবং পদ্মা সেতুর কাজও সরকারের বর্তমান মেয়াদেই শুরু হতে পারবে।
সরকার কোন পথে যাবে, এটা এখন তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা, দক্ষতা ও সাহসের ওপর নির্ভর করছে। সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য দেখে মনে হয় না, তাঁরা সহজে দেনদরবারের পথ ছাড়বেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে 'রাবিশ' বলে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। আমার ধারণা, এখন সবটাই প্রধানমন্ত্রীর ধৈর্য, সাহস ও কৌশলের ওপর নির্ভর করছে।
লেখাটি শেষ করে এনেছি এমন সময় জানতে পারলাম, আমাদের নোবেল লরিয়েটকে নাকি একটি ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর করা হয়েছে; সম্ভবত স্কটল্যান্ডে অবস্থিত একটি ইউনিভার্সিটির। এক গ্রামীণ ব্যাংকের তদন্ত বন্ধ করার জন্য নোবেল লরিয়েট কোনো প্রচেষ্টাই আর বাকি রাখছেন না। শেষ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলরেরও মুকুট ধারণ করলেন।
ব্রিটেনে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠছে। লন্ডন শহরে যত পলিটেকনিক ছিল, সব কয়টির মাথায় ইউনিভার্সিটি ছাপ দেওয়া হয়েছে। ড. ইউনূসের অর্থ এবং প্রভাবের জোর আছে। তিনি চাইলে এ রকম আরো কয়েকটি ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর হতে পারেন। (শেষ)

লন্ডন, ৩ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.