দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কিভাবে গড়া যাবে by মাহমুদ হাছান

একটা দেশের উন্নয়ন মানে আর্থসামাজিক উন্নয়ন। আর্থসামাজিক উন্নতির প্রত্যক্ষ মাপকাঠি হলো জিডিপি (Gross Domestic Product), গড় আয়ু, শিক্ষার হার ও মান, কর্মসংস্থানের হার ও মান। আর পরোক্ষ মাপকাঠি হলো ব্যক্তিমানুষের মর্যাদা, সমাজের সব সংগঠনের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি।


আমাদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। এর সঙ্গে যুক্ত অন্য নিয়ামকগুলো হলো- আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দরিদ্রতা, অশিক্ষা, অকার্যকর শিক্ষাপদ্ধতি, দুর্বল অবকাঠামো, অধিক জনসংখ্যা, হিংসাত্মক রাজনীতি, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, ক্ষুদ্র ও পশ্চাৎপদ মন-মানসিকতা।
যেকোনো রোগের সংক্রমণ ঘটলে আমরা অসুস্থ হই, দেহে জ্বর আসে। জ্বর কোনো ব্যাধি নয়, এটা প্রায় সব রোগ সংক্রমণের একটি সাধারণ উপসর্গ, তেমনি দুর্নীতি কোনো ব্যাধি নয়, এটা যেকোনো আর্থসামাজিক ব্যাধি বা অসংগতির একটা সাধারণ উপসর্গ। তাই দুর্নীতির নেপথ্যে যে আর্থসামাজিক ব্যাধিগুলো কাজ করছে, তা চিহ্নিত ও দূরীভূত করতে পারলেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা সহজ হবে।
দুর্নীতির নেপথ্যে যে আর্থসামাজিক ব্যাধি বা কারণগুলো কাজ করছে তা হচ্ছে-
সরকারি খাতের ব্যাপক উপস্থিতি
যে কারণে আমাদের দেশে দুর্নীতি হয়, তার প্রধানতম হলো সরকারি খাতের ব্যাপক উপস্থিতি। সরকারি খাতের ব্যাপকতা রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করছে, করছে শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনকে দুর্বৃত্তায়িত, অপ্রতিরোধ্য ও নিয়ন্ত্রণহীন। সরকারি খাতের ব্যাপক উপস্থিতি বোঝার জন্য আমেরিকা বা জাপানের সরকারি খাতে নেই; কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি খাতে আছে এমন সংস্থাগুলোর নাম নিম্নে দেওয়া হলো- বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ স্টিমার, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ, ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, পিডিবি, পাওয়ার গ্রিড, রোড অ্যান্ড হাইওয়েজ, এলজিইডি, এলজিআরডি, গণপূর্ত বিভাগ, আয়কর বিভাগ, শুল্ক বিভাগ, মৎস্য বিভাগ ও বন বিভাগ।
এ ছাড়া বাংলাদেশে সরকারি খাতে পরিচালিত হচ্ছে বেশ কিছু ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অসংখ্য কলকারখানা।
রাজনীতিতে অসৎ লোকদের ব্যাপক উপস্থিতি নিঃস্বার্থ-নিবেদিতপ্রাণ লোকদের রাজনীতি থেকে অপসারিত করে ও রাজনীতি হয় কলুষিত। আর কলুষিত রাজনীতি দেশের সব প্রতিষ্ঠানকেই ধ্বংস করে। বাংলাদেশ যার জ্বলন্ত উদাহরণ। এটা সরকারি খাতের ব্যাপক উপস্থিতির এক অদৃশ্যমান ভয়াবহ ক্ষতি।
অন্যদিকে দুর্নীতির সুযোগ সংবলিত সরকারি খাতের অনুপস্থিতির জন্য আমেরিকা বা জাপানে অসৎ লোকেরা রাজনীতিতে আসেন না।
সামাজিক নিরাপত্তা
প্রধান প্রধান যে কারণে দেশে দুর্নীতি হয়, তার দ্বিতীয়টি হলো সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। সামাজিক নিরাপত্তা বস্তুত এক ধরনের সামাজিক বীমাব্যবস্থা, যার মাধ্যমে কোনো দেশের নাগরিকরা পূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা যথা- দারিদ্র্যভাতা, বয়স্কভাতা, বেকারভাতা, অক্ষমতাভাতা ও পেনশনভাতা ইত্যাদি পেয়ে থাকে।
সামাজিক নিরাপত্তা নতুন কোনো দাবি নয়। এটা '�Universal Declaration of Human Rights� এবং �International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights� কর্তৃক স্বীকৃত সর্বজনীন মানবাধিকার।
সামাজিক নিরাপত্তা নাগরিকদের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন চেতনা বৃদ্ধি করে। একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাক।
অনেকেই জানেন, সিঙ্গাপুরের নিয়োগদাতারা তাঁদের কর্মচারীদের ভয় পান। তাঁরা তাঁদের কর্মচারীদের এমন কিছু করতে বলেন না, যা দেশ ও প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকারক। দেশ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকারক এমন কিছু করতে বললে কর্মচারীরা প্রথমেই পুলিশকে ব্যাপারটা জানান। এরপর একটা পদত্যাগপত্র লিখে টেবিলের ওপর রেখে অফিস ত্যাগ করেন। আর এ জন্য সিঙ্গাপুরের কোনো কম্পানির মালিকের পক্ষে কর্মচারীদের মাধ্যমে দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। কর্মচারীদের এমনতর আচরণ কি সামাজিক নিরাপত্তাহীন বাংলাদেশে আশা করা যায়?
সামাজিক নিরাপত্তা নাগরিকদের জীবন উপভোগের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করে। অনেকেই জানেন যে ইউরোপ বা আমেরিকায় যাঁরা সপ্তাহান্তে বেতন পান, তাঁরা তাঁদের বেতনের প্রায় পুরোটাই সাপ্তাহিক ছুরির দুই দিনে খরচ করে ফেলেন। বাংলাদেশের চাকরিজীবীরা কি তা পারেন? জীবন উপভোগের স্বাধীনতা সঞ্চয়ক্ষুধা কমায়, যা অনিবার্যভাবে ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা কমায়; অন্যদিকে ভোগ বাড়ায়, যা অনিবার্যভাবে পণ্য ও সেবার উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ইউরোপ বা আমেরিকায় কি ঘুষ-দুর্নীতি নেই? আছে। কিন্তু তা একদিকে সামাজিক নিরাপত্তার কারণে গ্রহীতার কাছে পরিমাণগতভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বা ব্যয়বহুল হতে হয় এবং অন্যদিকে আইনের শাসন থাকায় দাতা ও গ্রহীতা উভয় পক্ষের জন্যই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। এই উভয়বিধ কারণে এর ব্যবহার সীমিত। আর সামাজিক নিরাপত্তা না থাকার কারণে আমাদের দেশের লোকেরা সামান্য টাকার জন্য নিজের বিবেককে বিসর্জন দিয়ে ঘুষ গ্রহণ করে থাকে, যদিও এ দেশের নাগরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধ ইউরোপ বা আমেরিকার মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। সামাজিক নিরাপত্তা না থাকার কারণে এ দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ ভাবনা সর্বদাই অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে। সন্তান মানুষ না হলে তার শেষ জীবন কিভাবে কাটবে, তা সে জানে না। সন্তান মানুষ হলেও সে চাকরি পাবে কি না বা চাকরি পেলেও বৃদ্ধ বয়সে তার ভরণপোষণ করবে কি না তা তার জানা নেই। বড় অসুখে পড়লে বা কোনো কারণে অক্ষম হয়ে পড়লে তার জীবন কিভাবে কাটবে, তা তার জানা নেই। এ দেশের মানুষ তাই সহজেই ঘুষ-দুর্নীতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভাব
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এ অগ্রগতির নিরঙ্কুশ দাবিদার বেসরকারি খাত। কিন্তু বেসরকারি খাতের সঠিক ও দুর্নীতিমুক্ত বিকাশ ঘটেনি। এর দায় সরকারি খাতের। সরকার বেসরকারি খাতের সঠিক ও দুর্নীতিমুক্ত বিকাশে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি।
উন্নত দেশের উন্নয়নেও মূল ভূমিকা পালন করে থাকে বেসরকারি খাত। তবে সেখানকার সরকারি খাত কার্যকর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের সঠিক ও দুর্নীতিমুক্ত বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সরকার আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে প্রতিটি ট্রেডকেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
বাংলাদেশে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ওষুধের মান ব্যতিরেকে অন্য প্রায় সব ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। এ দেশে যেকোনো ব্যবসা করার ট্রেড লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা অথবা সিটি করপোরেশন প্রদান করে থাকে। যদিও এটা তাদের কোনো মুখ্য দায়িত্ব নয়। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা যাদের লাইসেন্স দিয়ে থাকে, তাদের কার্যকলাপ তদারকি বা নিয়ন্ত্রণে কোনো দায়দায়িত্ব লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হয় না।
রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলো (Diagnostic centers) প্রদত্ত 'ডক্টরস কমিশন' বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতির এক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করেছে। এই অবৈধ কমিশন চিকিৎসকদের প্রলুব্ধ করছে ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার নাম লিখতে, নষ্ট করছে চিকিৎসকদের রোগীর রোগের বর্ণনা ও লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে রোগ নির্ণয়ের সহজাত প্রবৃত্তি ও সক্ষমতা, চিকিৎসাকে করছে ব্যয়বহুল এবং সর্বোপরি চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মনোভাব ও মনোযোগের অভাব বৃদ্ধি করে বাড়াচ্ছে রোগ নির্ণয়ে ভুলের ব্যাপ্তি, নামাচ্ছে চিকিৎসার মান।
প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন রোগ নির্ণয়কেন্দ্র স্থাপনের লাইসেন্স প্রদানের শুরু থেকেই- সম্ভবত সত্তর দশকের শেষের দিকে। কার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও কোনো ধরনের নীতিমালা না থাকার কারণে রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলো অবাধে যে শুধু ডক্টর্স কমিশনই প্রচলন করেছে তা নয়, তারা নিম্নমানের এবং কখনো কখনো পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি আমদানি করে অসহায় ও বিত্তহীন চিকিৎসাপ্রার্থীদের প্রতারিত করে আসছে।
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঠিক, দুর্নীতিমুক্ত ও সুষ্ঠু বিকাশে কার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যের শুধু সুষ্ঠু বিকাশই নিশ্চিত করবে তা নয়, এটা ভোক্তার অধিকারও রক্ষা করবে। যেকোনো ব্যবসার লাইসেন্স প্রদানের অধিকার সে ব্যবসার নিয়ন্ত্রক সংস্থার থাকা উচিত। সংগত কারণেই বলা যায়, আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভাবই আমাদের অর্থনীতির আরেকটি বড় ব্যাধি।
সুষ্ঠু মন-মনন-মানসিকতার অভাব
ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের মানুষ কুটিল ও পশ্চাৎপদ মন-মনন-মানসিকতার ধারক ও বাহক। পরশ্রীকাতরতা, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, নগর ও সমাজ সচেতনতার অভাব এ দেশের মানুষের একটা বড় সমস্যা। এ দেশের অনেক মানুষকে মৎস্য খামার বা পুকুরে নির্দ্বিধায় বিষ প্রয়োগ করে অপরের ক্ষতি করতে দেখা যায়। ঔপনিবেশিক মানসিকতা এখনো রয়ে গেছ। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়দায়িত্ব যেন কোনো নাগরিকের নয়। জাতপ্রথার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। সব কাজকে একই সম্মানের চোখে দেখা হয় না। মাঠে-ঘাটে কাজ করলে বলা হয় চাষাভুষা, আর চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করলে বলা হয় কর্মকর্তা। চাকরিজীবীদের সম্মান স্বকর্মে নিয়োজিতদের চেয়ে বেশি। বিভেদের বিষবাষ্প সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কাজ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, আয়- সব কিছুই মানুষের মধ্যে বিভেদের জন্ম দেয়। সব কাজকে একই সম্মানের চোখে দেখা হয় না বলে এ দেশের অনেক মানুষ বেকার থাকে।
এ দেশের মানুষ কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে আন্তরিক নয়। তারা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলে এবং ব্যক্তিগত কাজে বা গালগল্পে ব্যস্ত থাকে। প্রতিষ্ঠানের অর্থ অপচয় বা আত্মসাৎ করতে অনেকেই দ্বিধা করে না। এটাই এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায়। আর আমাদের অর্থনীতির দুর্বলতম খাত হলো স্বল্প বিদেশি বিনিয়োগ।
মানুষের এ কুটিল মন-মানসিকতার জন্য এ দেশেরই অনেকে ব্যবসা করতে ভয় পায় ও বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকে। কাজেই এ দেশের মানুষের মন-মনন-মানসিকতা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের আরেকটি বড় বাধা। লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা
mahmoodhasanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.