আ মা র এ ভা রে স্ট অ ভি যা ন-চূড়ার কাছাকাছি by ওয়াসফিয়া নাজরীন

২৬ মে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন তাঁর এভারেস্ট অভিযানে। পাঠকদের সেই অভিযানের কথা শোনাচ্ছেন তিনি। আজ ছাপা হলো এর দ্বিতীয় পর্ব—


এভারেস্ট বেসক্যাম্প, যেখানে উড়ছে বাংলাদেশের বিশাল একটি পতাকা; মনে হচ্ছে, আমার বাড়িতেই যেন ফিরে এসেছি। এখান থেকেই শুরু হবে ওপরে, আরও ওপরে ওঠা। বেসক্যাম্প থেকে সময়-সুযোগ পেলেই ফেসবুকে জানিয়ে দিতাম আমার অভিযানের অবস্থা। ফেসবুকে আমার বন্ধু-স্বজন, এমনকি অপরিচিত লোকজনও শুভেচ্ছা জানাতেন, দোয়া করতেন। ওয়াসফিয়া—গো অ্যাহেড, মিন্ডি! (আমার ডাকনাম) তুমি সফল হও, কত কত শুভেচ্ছা। মনে হতো, পুরো দেশবাসী আমাকে ওপরে ওঠার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে, আর আমিও সেই শক্তি নিয়ে অনেক স্বস্তি পেতাম।
এভারেস্ট অভিযানটা আমার কাছে যতটা না ফিজিক্যাল জার্নি, তার চেয়েও অনেক বেশি স্পিরিচ্যুয়াল জার্নি। বৈরী আবহাওয়ায় পড়েছি, যে বন্ধুর সঙ্গে হেসে গল্প করেছি, কদিন পরই দেখেছি তাঁর মৃতদেহ। অভিযানে যাওয়ার আগে উইল করে গিয়েছিলাম, ‘কোনো কারণে আমার মৃত্যু হলে আমার দেহ যেন ফিরিয়ে আনা না হয়।’ যে অর্থের প্রয়োজন মৃতদেহ আনার, সেটা দিয়ে অন্য কোনো মেয়ে অভিযানে যেতে পারবে।
বেসক্যাম্পে আসার পর একটা ফুরফুরে ভাব চলে আসে আমার মধ্যে। কুম্ভু কফও সেরে গেছে। ওই যে বেসক্যাম্পের দুই ধাপ নিচে নেমে গেছিলাম, তারই সুফল এটা। ওখানে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। মে মাসের শুরুতে বেসক্যাম্পে একটি সভা হয়। তখনো সামিটের জন্য রশি বসানো হয়নি। ১৮ আর ১৯ মে বাতাসের অবস্থা সবচেয়ে বাজে থাকবে। সামিটের জন্য ভালো সময় হতে পারে ২৫ মের পর। পর্বতারোহণের ব্যাপারে আমি যাঁদের কথা মানি, তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপেক্ষা করাটাই ঠিক করি। আমার দলের কথা ছিল, ‘সেফটি ফার্স্ট, নট সামিট ফার্স্ট’।
ক্যাম্প-৩-এ আগেই আমার তাঁবু গাড়া ছিলো। সঙ্গে ছিল শেরপাদের টেন্টও। ১৭ মে ভোর পাঁচটায় আমাকে ডেকে তোলা হলো তাঁবু থেকে। জানলাম, ক্যাম্প-৩-এ আমার তাঁবু গন! তাঁবুর ভেতরে ছিল ৫টা অক্সিজেন সিলিন্ডার ও এক বস্তা খাবার। বরফের বড় বড় চাঁই এসে গুঁড়িয়ে দিয়েছে আমার তাঁবু। এই তাঁবুতে আমি ঘুমিয়েও থাকতে পারতাম! ক্যাম্প-৩ যেখানে, সেখানকার পর্বত ৬৫ ডিগ্রি কোণে খাড়া। পর্বতের সেই খাড়া গায়ে খাঁজ কেটে কেটে তাঁবু গাড়তে হয়। বাইরে থাকে রড। এখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয় রশিতে ঝুলে ঝুলে। আমি একটা খেলা শুরু করেছিলাম। আমার শেরপা ওই রশি ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। একবার রশিতে টান দেওয়া মানে ‘টয়লেট পেপার পাঠাও’, দুবার রশিতে টান মানে ‘আমার আরও সময় লাগবে।’ এই রকম আর কি...।
তাঁবু নষ্ট হয়ে গেছে মানে আমাদের সামিট পুশ করায় আরও একটু দেরি হলো। ১৮ মে শেরপাদের একটি দল চলে যায় সামিট মানে এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার পথে রশি বসাতে (রোপ ফিক্সিং)। উচিত নয়, তার পরও কয়েকটি দল এই দড়ি বাঁধার দলের পেছনে পেছনে যায় এভারেস্ট চূড়ায় উঠতে। আমরা কোনো ঝুঁকিই নিতে চাই না, ফ্রস্ট বাইটেও তো আমি হাতের আঙুল হারাতে পারি চিরদিনের জন্য। মনে মনে বলি, ‘আমার তো আরও পাহাড়ে উঠতে হবে। এখানেই সব শেষ কইরা গেলে তো চলবে না।’
পাহাড়ে অলস সময় কাটাতে হয় না, সব সময় অ্যাকটিভ না থাকলে শরীর একেবারে ছেড়ে দেয়। তাই ১৯ মে যাই বেসক্যাম্পের কাছে পুমুরির হাই ক্যাম্পে। সেখান থেকে ফিরে এসেই খবর পাই, নিশাত মজুমদার আর এম এ মুহিত সামিট করেছেন। লিয়াজোঁ অফিসাররা জানান খবরটা। মনটা খুশিতে ভরে যায়। মন থেকে তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে রাখি এবং ফেসবুকে তাদের উদ্দেশে একটি নোট লিখে প্রকাশ করি। সেদিন আবার তীব্র বাতাস এভারেস্ট চূড়ার দিকে। এর মধ্যে রেডিও বার্তায় ভেসে আসে দুই কোরীয় আর এক বাংলাদেশি (নিশাত মজুমদার) স্নো ব্লাইন্ডনেসে আক্রান্ত। নেমে আসার পথে চূড়ার কাছে আটকে আছেন। টেনশন বাড়তে থাকে। নিশাতের কী হলো! উৎকণ্ঠায় কাটে সারাবেলা। সন্ধ্যার দিকে জানতে পারি, নিশাত ঠিকঠাক মতোই নামতে পেরেছেন। তবে শেরপাদের কথা না শুনে সময়মতো নেমে না আসায় এক কোরীয় ওখানেই রয়ে যান। পরের দিন জানতে পেলাম, তিনি ওখানেই ঠান্ডায় জমে ‘হাইপোথারমিয়া’ হয়ে মারা গেছেন। এভারেস্ট এমনই।
২০ মে আমরা তৈরি হচ্ছিলাম, সবকিছু গোছগাছ করছিলাম—এবার চূড়ার পথে যাত্রা শুরু। দেখি, নিমা বাড়তি ৫০ গজ রশি নিচ্ছেন। বললাম, এত রশি নিচ্ছেন কেন? নিমার উত্তর, ‘ওয়াসফিয়াজি, ইউ নেভার নো হোয়েন ইউ নিড ইট।’ পরে বুঝেছিলাম এই ৫০ গজের মাজেজা।
সামিটে যাওয়ার আগে শেরপারা আরেকটি পূজা করেন। একটি বেদিতে আগুন জ্বালানোই থাকে সামিট শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আর এই পুরো সময় শেরপারা পালা করে কেউ না কেউ প্রার্থনা করেন বেদিতে।
এভারেস্টে একদল শেরপা আছেন, যাঁদের আইস ডক্টর বলে। এই ডাক্তারদের কাজ হলো বরফ পরীক্ষা করা, বরফের গতিবিধি বোঝা। তাঁরা বলে দিয়েছেন, যা-ই করো, ২৯ মের মধ্যে রশি, তাঁবু, মই—সব নামিয়ে আনতে হবে। আমরা যখন রওনা হই, তখন খেয়াল করি বরফ গলতে শুরু করেছে। তার মানে সামিট মৌসুম একেবারে শেষের দিকে। নরম হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। জুতার ক্র্যাম্পুন কামড় বসাতে পারে না। ২৪ মে ক্যাম্প-৪ থেকে বোঝা গেল এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার পথে লেগেছে ট্রাফিক জ্যাম। আমার ইচ্ছা ছিল ২৫ মে চূড়ায় ওঠার। আমার সামনে প্রায় ৩০০ জন। ২৪ মে রাতেই শ দেড়েক পর্বতারোহী সামিট করার চেষ্টা করছে। রাতের বেলা এ দৃশ্য দারুণ! দূর আকাশে কালো অন্ধকারে আবছা এভারেস্ট চূড়া। তার গায়ে আঁকাবাঁকা অসংখ্য জোনাকির আলো। আসলে এগুলো অভিযাত্রীদের মাথায় বাঁধা হেডল্যাম্পের আলো। ট্রাফিক জ্যামের কারণে সামিট পুশ আরও এক দিন পিছিয়ে দিলাম। আট হাজার মিটারের ওপরের এই ‘ডেথ জোন’ ক্যাম্প-৪, যা কিনা সাউথ কোল নামেই পরিচিত, সেখানে আরেক রাত কাটালাম। ক্যাম্প-৪-এ মনে হচ্ছিল আমরা যেন চাঁদে বসবাস করছি। সবাই কৃত্রিম অক্সিজেনে পুরোপুরি। চোখ বন্ধ করলেই দুঃস্বপ্ন হানা দিত। ক্যাম্প-৪-এ একবার সবাইকে ‘হাই হ্যালো’ বলতে থাকি। একজন জার্মান একটা পাথরের ওপর বসেছিলেন, তাঁকেও ‘হাই’ বলি। কোনো প্রত্যুত্তর পাই না, পরে শুনি তিনি মৃত!
(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)
wasfia@bdon7summits.org

No comments

Powered by Blogger.